মা-বাবা-ভাই-বোন কেউই নেই নিহত তোফাজ্জলের

আইন আদালত জাতীয় মফস্বল

সুবর্ণবাঙলা প্রতিনিধি


নিহত তোফাজ্জল হোসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারানো তোফাজ্জল হোসেনের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়। চার বছর আগে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। কেউই না থাকায় তোফাজ্জলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়নি। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন ভবঘুরে তোফাজ্জল।

স্থানীয়রা জানান, তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তোফাজ্জল ছিলেন ছোট। এক সময় তিনি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিলেন। স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত সজ্জন, পরিচ্ছন্ন ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তোফাজ্জল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার পরিবারে নেমে আসে একের পর এক স্বজন হারানোর বেদনা।

আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার বাবা। এরপর স্থানীয় এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বিচ্ছেদ হওয়াকে কেন্দ্র করে তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। চার বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার মা। মা হারানো শোকে মানসিক সমস্যা আরও বেড়ে যায় তোফাজ্জলের। এরপর তোফাজ্জলকে সুস্থ করতে চিকিৎসার উদ্যোগ নেন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক পদে কর্মরত তার একমাত্র বড় ভাই। এরই মধ্যে গত বছর হঠাৎ করে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার বড় ভাইও।

তাই বাবা, মা, ভাই, বোনহীন হয়ে পড়ায় তোফাজ্জলের আর চিকিৎসা হয়নি। এরপর থেকেই তার ভবঘুরে জীবন শুরু হয়। তোফাজ্জলকে মাঝে মাঝে পাথরঘাটা দেখা গেলেও অধিকাংশ সময় তিনি থাকতেন লাপাত্তা। তবে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তাকে দেখেছেন পাথরঘাটার অনেকে। কখনো উদোম শরীরে, আবার কখনো নোংরা পোশাকে তাকে দেখা যেত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। পরিচিত কেউ তাকে দেখলে খাবার কিনে দিতেন। আবার কারো কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েও তিনি খাবার কিনে খেতেন।

মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নির্মম নির্যাতন করে মেরে ফেলায় ক্ষুব্ধ পাথরঘাটাসহ বরগুনার স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের দাবি, খুনি কখনও মেধাবী হতে পারে না। অপরাধীর পরিচয় শুধু অপরাধীই। তাই তারা তোফাজ্জলকে নির্যাতনকারী সবার শাস্তি দাবি করেছেন।

এদিকে তোফাজ্জেল হত্যার ঘটনা হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরগুনার শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বরগুনা প্রেসক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ সমবেশ করেন তারা।

পাথরঘাটার চারণ কবি ইদ্রিস আলী বলেন, মেধাবীরা কি করে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। ছেলেটির মা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই, বোন নেই। অভিভাবকহীন এরকম একটি মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। নিহত তোফাজ্জলের কোনো অভিভাবক না থাকায় অপরাধীরা যাতে পার না পেয়ে যায় সেজন্য তিনি রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হোসাইন বলেন, তোফাজ্জেল অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী ছেলে ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এ তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। আমিসহ পাথরঘাটার অনেকেই তোফাজ্জেলকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি খাবার কিনে দিয়েছি চিকিৎসার ও উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে মানুষকে চাইলেই তো আর সুস্থ করে তোলা যায় না। আমরা তোফাজ্জলকে সুস্থ করে তুলতে পারিনি। তাই বলে তোফাজ্জলকে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাও আমরা মেনে নিতে পারি না। আমরা তোফাজ্জলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

তোফাজ্জলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরীফা আক্তার বলেন, তোফাজ্জলকে মারার আগে আমার ফোনে কল দেয়। তোফাজ্জল সম্পর্কে কী হয় সে কথা জানতে চায়। দেবর এ কথা বলার পরেই তিনি বলেন, তোফাজ্জল চুরি করে ধরা পড়েছে, তাকে বাঁচাতে হলে দুই লাখ টাকা দিতে হবে। এরপর তারা ফোনে ধমক দিতে থাকেন এবং বলেন, কোন মিথ্যা কথা বলবেন না, তাহলে সমস্যা হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পরে বিভিন্ন লোকজনে ফোন দিয়ে জানান, তোফাজ্জল মারা গেছেন। আমার স্বামীর বংশ পরিচয় দেওয়ার মতো আর কিছুই রইল না। আমার দুই ছেলে, তারা বাবা হারা, তাদের একজন চাচা ছিল তাও শেষ করে দিল। আমরা আল্লার কাছে বিচার দিলাম, যারা এ কাজ যারা করেছে তাদের যেন বিচার করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *