Uncategorized খোলা কলাম

সৌন্দর্যচেতনায় শৈশবে রূপকথার গল্পের প্রভাব

ছোটবেলা থেকে আমরা অনেকে বাবা-মা, দাদী-নানীদের কাছ থেকে ঘুমানোর আগে গল্প শুনতাম।তাদের মুখে রূপকথার গল্প শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম আমরা অনেকেই।দৈত্য-দানব, পরী, রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প শুনে আনন্দকে খুঁজে নিতাম আমরা অনেকেই। রূপকথার গল্প শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়।জীবনের সমস্যা, আনন্দ, ভালো খারাপের পার্থক্য শেখানো হয় গল্পের মাধ্যমে। ভালোমন্দের তফাত বুঝতে পারা, প্রাণীদেরকে ভালোবাসা, গল্প বলতে শেখা এবং কল্পনাশক্তির বিকাশটাও রূপকথার গল্পের মাধ্যমে শেখা হয়ে থাকে।রূপকথার গল্প সাধারণত সব শিশুর কাছে জনপ্রিয় হলেও এর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানা যায় যে, সাধারণত ছেলে শিশুদের চাইতে মেয়ে শিশুরাই রূপকথার গল্পগুলো বেশী পছন্দ করে এবং এই গল্প দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে।মেয়েরা বেশিরভাগ রাণী, রাজকুমারী কিংবা পরীর গল্প ভালোবাসে, নিজেদেরকে তেমন করে ভাবতে পছন্দ করে। অন্যদিকে ছেলেরা নায়কচরিত্র সাহসিকতা, যুদ্ধ, এডভেঞ্চার বেশি পছন্দ করে।

বর্তমানে শিশুরা শুধু গল্পের বইতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, এনিমেশন কার্টুন, সিনেমা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে।

 

মূলধারণা: রূপকথার গল্প মানে যেমন খুশি তেমন ভাবা। কল্পনার গন্ডির কোনো সীমা থাকেনা। তবুও এই রূপকথার গল্পগুলোতে কিছু সাধারণ সমস্যা থাকে। এই সমস্যাগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক কিংবা লৈঙ্গিক, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হতে পারে। রূপকথার গল্পে কিছু সাধারণ সমস্যা রয়েছে তাই এগুলো শিশুর মনে কখনও নেতিবাচক ধারণার প্রভাবও ফেলতে পারে। যেমন মেয়েদের জন্য বিশেষ করে অবাস্তব সৌন্দর্যের ধারণা, সাহসী ভূমিকার কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাব এই ব্যাপারগুলোর প্রভাব পড়ে থাকে। আমার নিজ অভিজ্ঞতা আলোকে যা বুঝেছি, ছোটবেলা থেকেই আমি ভীষণ রূপকথার গল্পের বই পড়তে পছন্দ করতাম। গল্পে গল্পে কল্পনাতে হারিয়ে যেতাম। কখনও নিজেকে প্রজাপতি, কখনও পরী রূপে কল্পনা করতাম। ভাবতাম পরী বা প্রজাপতি হলে আমার দুটি সুন্দর ডানা হবে। এই কল্পনাকে আরও রঙিন করে তোলে রূপকথার গল্প নিয়ে ডিজনির বিভিন্ন বারবি কার্টুন চরিত্র। বারবির মতো যাদুবলে সুন্দর জামা, হেয়ারস্টাইল বা পরীরূপে থাকলে সবার চাইতে সুন্দর দুটি ডানা পাবার কল্পনা করে কাটিয়ে দিতাম। সেই সময় আমার মতো আরও যেসব বাচ্চা মেয়েরা আছে তারা এসব ডিজনির এই বারবি কার্টুনটাকে মূলত পছন্দ করে থাকবে এই কারণেই। রূপকথার গল্পের পাশাপাশি অন্য বিষয়ে ছোটদের গল্পের বই পড়লেও আমার আগ্রহ, ভালোলাগা,পছন্দটা ঘিরে ছিলো রূপকথার জগতকে নিয়ে। আজ বড় হয়ে ভাবি আমার মনে এত ছোট বয়সে সৌন্দর্যবোধের ধারণা কী করে চলে আসে যেখানে আমার পরিবার আমাকে শেখায়নি কালো মানে অসুন্দর আর সাদা চামড়া বা ফর্সা মানেই সে সুন্দর? ছোটবেলায় যখন মানুষের ছবি আঁকতাম তখন flesh কালারটিকে ফর্সা এবং burnt sienna রঙটিকে কালো রঙ ভেবে মানুষের গায়ে flesh কালারের বেশি ব্যবহার করতাম। কখনও কখনও দরকার পড়লে হলুদ রঙটির ব্যবহার করতাম। মাঝেমধ্যে তখনও বাচ্চা মনে প্রশ্ন জাগতো আমাদের চুলের রঙ যদি হয় কালো তবে আমরা কী করে কালো? বড় হয়ে আমি নিজেই এই ভাবনার মূল উৎস খুঁজে পাই। রূপকথার গল্পে নারীচরিত্রগুলো বেশ আকর্ষণীয়, চটকদার হয়ে থাকে। যেখানে রাজার আদরের রাজকুমারী কিংবা রাণী হয়ে থাকে সবচেয়ে সুন্দর। বনের মধ্যে শিকার করতে গেছে রাজকুমার দুধে আলতাবরণ গায়ের রঙ, দীঘল কালো চুল দেখে রাজকুমার শিকার ভুলে রাজকুমারীর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। হঠাত মনে নিজের সাথে তুলনা চলে আসতো, কই, আমার রঙ তো দুধে আলতা বরণ নয়! আমি তো শ্যামলা (রাজার পুত্র রাজার কন্যা কিংবা রাণী হলেই যে সুন্দর এটি মূলত একটি অবাস্তব সৌন্দর্যের ধারণা)। ভাবনাগুলো এখানে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি আরও প্রসারিত হয়েছে টিভিতে দেখানো ডিজনির কার্টুন আমার কল্পনা সৌন্দর্যের ধারণাকে ছুঁয়ে দেখায়। দুই হাজার সালের দিকে “ফেয়ার এন্ড লাভলী” নিয়ে বিজ্ঞাপন দেখানো হতো। কালো হবার কারণে মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা, সে “ফেয়ার এন্ড লাভলি”-র ক্রিম মেখে ফর্সা হয় তার চাকরি হচ্ছে বিয়ে হচ্ছে। এইযে বিভিন্ন ত্বক ফর্সা বা উজ্জ্বল করার যে বিজ্ঞাপন এইগুলো ছোট বয়সে তখনই আমার মনে গেঁথে যায়। ভাবতাম আমি, এগুলো মেখে সত্যিই আমার চামড়ার রঙ সাদা হবে, সুন্দর হবো আমি, সবাই আমাকে ভালোবাসবে, এটেনশন দিবে!

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য “ফেয়ার এন্ড লাভলি” ক্রিমটি নাম পরিবর্তন করে এখন “গ্লো এন্ড লাভলি” হিসেবে চলছে। কিন্তু তাই বলে কি সৌন্দর্যের ধারণাকে পুঁজি করে একচেটিয়া বিজনেস কি বন্ধ হয়ে গেছে?

আমাদের দেশে যেসব মেয়েদের গায়ের রঙ একটু চাপা তারা রূপকথার গল্প থেকে না হোক পরিবারের বর্ণবাদী মানুষ, টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়ার জগত, এনিমেশন নানান জায়গা থেকে নানানভাবে খুব ছোট বয়সেই সৌন্দর্য নেতিবাচক ধারণা পেয়ে থাকে। আমাদের দেশের মানুষ সৌন্দর্য নিয়ে পুরোনো বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এখনও। আমার মূল ভাবনা সৌন্দর্য নিয়ে নানান জায়গা থেকে নানানভাবে পাওয়া “শৈশবে রূপকথার গল্পের প্রভাব”-টিও সেই প্রতিফলিত ধারণারই একটি অংশ!

 

জরিপ: যেহেতু সব শিশু রূপকথার গল্প বা বই পড়েনা তবে রূপকথার গল্পগুলি কেবল বই বা গল্পের মাধ্যমে নয়, বিভিন্ন মাধ্যমে শিশুদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে। এ প্রভাবগুলি মিডিয়া চলচ্চিত্র থেকে আসতে পারে। বর্তমানে শিশুরা শুধু গল্পের বইতেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, এনিমেশন কার্টুন, সিনেমা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই বেশি সময় কাটানো হয় তাদের। আবার অনেক শিশু যাদের গায়ের রঙ একটু শ্যামলা পর্যায়ের তারা এই কারণে পরিবার থেকে, টিভি মিডিয়ার বিজ্ঞাপন থেকে নানাভাবে সৌন্দর্য নিয়ে ধারণা পেতে পারে।

রূপকথার গল্প নিয়ে যে কার্টুন বা এনিমেশন তৈরি হয় ইউটিউবে সেখানে কার্টুনগুলো দেখলে দেখা যায় যে, নারী চরিত্রের রঙ বেশিরভাগ সাদা রঙের হয়ে থাকে। বিজ্ঞাপন ও পণ্য বিতরণের মাধ্যমে সৌন্দর্যচেতনার ধারণা তৈরি হয়ে থাকে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন পেইজ গায়ের রঙ ফর্সাকারী বিভিন্ন উপাদান ক্রিম, সাবান বিক্রি করে তাতে করে প্রভাবিত হয়। পরিবারের বড়দের মুখে গল্প শুনে নানাভাবে সৌন্দর্যচেতনার ধারণা জন্মাতে পারে। ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি প্লাটফর্মে ছোটদের জন্য রূপকথা বা সৌন্দর্যের আদর্শ সম্পর্কে নানা ধরণের ভিডিও এবং পোস্ট দেখা যায়, যা তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

রেফারেন্স: Quora নামের একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম যেখানে বিভিন্ন মানুষ প্রশ্ন করে থাকেএবং উত্তর দিয়ে যায়। রূপকথার গল্পগুলো বাচ্চাদের মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে এই বিষয়ে জানতে গিয়ে quoraতে এমনই এক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। (https://bn.quora.com/%E0%A6%B0%E0%A7%82%E0%A6%AA%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF/answers/254837616?ch=15&oid=254837616&share=69d221ee&srid=uc8Gz1&target_type=answer&fbclid=IwY2xjawHZwUlleHRuA2FlbQIxMQABHSKWv3LDmRGgv5NJLLRFjBt2gVJw4UFmr4sC6ixuZ9mIrUk00Vc_ERUDow_aem_EVLDNuemmULrxoiaKYBI1w)

বিবিসিতে ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদন করা হয়, রঙ ফর্সা করার জন্য কত লাখ লাখ নারীদের মূল্য চুকাতে হচ্ছে। প্রতিবেদনটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নারীদের নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্রিম বা উপাদান মেখে ত্বকের রঙ একেবারেই বদলে ফেলা সম্ভব নয়। যদি সেটা হয়ে থাকে তবে ত্বকের জন্য এটি একেবারেই ক্ষতিকারক। আমাদের দেশেও সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু উঠতি নারী ব্যবসায়ী ত্বকের রঙ ফর্সা করার ক্রিম নিয়ে একচেটিয়া বিজনেস করে যাচ্ছেন।
https://www.bbc.com/bengali/news-48867920?fbclid=IwY2xjawHZu5VleHRuA2FlbQIxMQABHZgkelSKExZqnZqxmI6zl-IOaaAr3iRY4TphpFiV6dn9voKGPDLNdTgMfQ_aem_MMjFCGewP4JMCUUYO6UzkQ (বিবিসির করা প্রতিবেদন)

 

 

https://othervoice.in/article/ov-7-12-23-3?fbclid=IwY2xjawHYrRNleHRuA2FlbQIxMQABHcvlLCnNb_5dRYNmdx9dwFcgVIq5c7lfOKaR08I58kYgexcmmkqbsIxeSg_aem_WN8IxmjZh_m9I4lawLlu6Q (ঠাকুমারঝুলি ঝলি: রাক্ষুসী ও নারীবিদ্বেষ)

 

https://nariongan.com/2024/06/08/%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%81/?fbclid=IwY2xjawHYrVZleHRuA2FlbQIxMQABHQVxTv2DkIrrNGDfEFYoEsaM3MpO2YfcOdtHIP5mXY_lbVX0jXpucFfewg_aem_vwkbzNyv8pEiPuj8tDraWw
(অসুন্দর হওয়ার অধিকার: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সৌন্দর্য ও বয়োঃবৃদ্ধির মনস্তত্ত্ব)

https://sarbojonkotha.info/sk-28-nari-7/?fbclid=IwY2xjawHYrspleHRuA2FlbQIxMQABHVaSYPQd7Iz9t1hvw1ERphS9mkxDmbZJgbeSps60Q-bfU8EOiwCi67HbOw_aem_x_oEdu6UXkYNlhdh_3IgWA (শরীরী সৌন্দর্যের চক্কর এবং নারীর মন)

https://sarbojonkotha.info/sk-28-nari-7/?fbclid=IwY2xjawHYrspleHRuA2FlbQIxMQABHVaSYPQd7Iz9t1hvw1ERphS9mkxDmbZJgbeSps60Q-bfU8EOiwCi67HbOw_aem_x_oEdu6UXkYNlhdh_3IgWA (শিশু সাহিত্য: রাজকন্যাকে কেন সুন্দরী হতে হয়)

 

https://sarbojonkotha.info/sk-28-nari-7/?fbclid=IwY2xjawHYrspleHRuA2FlbQIxMQABHVaSYPQd7Iz9t1hvw1ERphS9mkxDmbZJgbeSps60Q-bfU8EOiwCi67HbOw_aem_x_oEdu6UXkYNlhdh_3IgWA (নারী সৌন্দর্যের চক্কর এবং নারীর মন)

ছোটদের রূপকথার কিছু গল্পের বইয়ের প্রচ্ছদ:

দেশি বিদেশি রূপকথার গল্প নিয়ে ছোটদের কার্টুন, এনিমেশনের লোগো:

শুধু রূপকথার গল্প পড়ে নয়, রূপকথা নিয়ে লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ, কার্টুন, এনিমেশন চিত্র দেখেও শিশুরা প্রভাবিত হতে পারে।

সাজিয়া শারমিন শ্রাবণী
চারুকলা বিভাগ

রোল: ১২৫৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *