নির্বাচনের বছরে ব্যাংক পরিচালকদের বড় ছাড়

অর্থ ও বাণিজ্য রাজনীতি

বিশেষ প্রতিনিধি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবারও ব্যাংকের মালিকদের আবদার পূরণ করল সরকার। ব্যাংকে পরিচালক পদে টানা ১২ বছর থাকার সুযোগ দিয়ে গতকাল ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। সংসদে উপস্থাপিত বিলে ৯ বছরের প্রস্তাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১২ বছর নির্ধারণ করে আইনটি পাস হলো। কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি দেখানো যাবে না– এমন সুযোগও রাখা হয়েছে। তাদের ঋণ পেতেও কোনো সমস্যা হবে না।

সম্প্রতি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আইনে এ দুটি বিষয় যুক্ত করার সুপারিশ করে। এর মধ্যে গত ৮ জুন বিলটি সংসদে উঠলে এক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি পাসের আগ মুহূর্তে সরকারি দলের সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটোর আনা সংশোধনী গ্রহণ করা হয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালক পদে ৬ বছরের পরিবর্তে টানা ৯ বছর এবং এক পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এবার তাঁদের জন্য সুযোগ আরও বাড়ানো হলো। গতকালের সংশোধনীতে ১২ বছর মেয়াদ কার্যকর হবে ২০১৮ সাল থেকে।
সংসদের বৈঠকে গতকাল বিলটি পাসের তীব্র বিরোধিতা করে ওয়াকআউট করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা। অবশ্য মাগরিবের নামাজের বিরতির পর তাঁরা আবার অধিবেশনে যোগ দেন। জাতীয় পার্টির একাধিক সদস্য এর বিরোধিতা করে বলেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে যে বিল উত্থাপন করেছেন, সেখানে টানা ১২ বছর পরিচালক থাকার প্রস্তাব ছিল না। বিলটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো এবং স্থায়ী কমিটির রিপোর্টেও বিষয়টি উল্লেখ নেই। শুধু সরকারি দলের একজন সদস্যের প্রস্তাব গ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ বিধান যুক্ত করা জনস্বার্থবিরোধী। প্রস্তাবটি উত্থাপনকালেও বিরোধী সদস্যরা ব্যাপক হইচই করেন। এই সংশোধনী প্রস্তাব আইনগত শুদ্ধ কিনা– সে বিষয়ে তাঁরা স্পিকারের রুলিং দাবি করেন। পরে কার্যপ্রণালি বিধি পরীক্ষা করে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদকে জানান, অপ্রাসঙ্গিক না হলে বিলে সংশোধনী আনতে কোনো সমস্যা নেই।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের পর থেকে আর্থিক খাতে সংস্কারের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে হঠাৎ করে আবার অনেক কিছু শিথিল করা হচ্ছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি হওয়া ঠেকাতে বড় ছাড় দিয়ে সার্কুলার করেছে। সেখানে বলা হয়, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে মেয়াদি ঋণে যে পরিমাণ কিস্তি পরিশোধ করার কথা; কেউ এর ৫০ শতাংশ দিলে আর খেলাপি হবে না।

ডলার সংকটের মধ্যে আইএমএফ ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে সরকার। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা আছে আগামী নভেম্বর। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ে আইএমএফ আর্থিক খাতে বিভিন্ন সংস্কারের লিখিত ও মৌখিক প্রস্তাব করেছে। ব্যাংকে এক পরিবারের প্রভাব কমাতে একই পরিবার থেকে পরিচালক পদের সংখ্যা কমানো এবং টানা পরিচালক পদে থাকার সুযোগ না রাখার সুপারিশ করে সংস্থাটি। সে আলোকে একই পরিবার থেকে পরিচালক সংখ্যা ৩-এ নামানো হয়েছে। আর দীর্ঘ ঘষামাজা শেষে গত ৮ জুন সংসদে যে বিল উঠেছিল, সেখানে পরিচালক পদে ৯ বছরের প্রস্তাবই ছিল। আবার ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয় রাখা হয়। তবে হঠাৎ পরিচালক পদের মেয়াদ ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করা হলো।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, একই গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি বিবেবচনা না করার সুযোগ ঋণখেলাপি হওয়াকে আরও উস্কে দেবে। এখন একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে নতুন নামে কোম্পানি খুলবে। এ ছাড়া এমনিতেই ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা বেনামি ও ভুয়া ঋণ। এ প্রবণতা এখন বাড়বে। কেননা, কারও এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলেও কিছু যাবে-আসবে না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, মালিকপক্ষের আবদারে এই সংশোধনী আনা হয়েছে। এর ফলে উদ্যোক্তা পরিচালকদের দৌরাত্ম্য আরও বাড়বে। তিনি বলেন, এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি না করার বিধান বিশ্বের অন্য কোথাও আছে বলে জানা নেই। এর ফলে এখন অনেকে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ইচ্ছা করেই খেলাপি হবে। এতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে কোনো সমস্যা হবে না। ফলে খেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি বাড়বে। এভাবে ব্যাংক খাতকে সরকার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে; বোধগম্য নয়।

সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্যরা পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, দেশে খেলাপি ঋণের জন্য মূলত দায়ী এ ধরনের পরিচালক। এদের পক্ষ নিয়ে সরকার কেন পরিচালকদের মেয়াদ বাড়াচ্ছে? তাঁরা বলেন, পরিচালকদের মেয়াদ আজীবন রেখে আইন পাস করে দেওয়া হোক। লুটপাট যখন করবেই; আজীবন করুক। তারা খেতে থাক; আমরা দেখতে থাকি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে আইনটি একবার সংশোধন করা হয়েছিল। তখন ব্যাংক মালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ রাখা হয়েছিল।

গত ৮ জুন বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওই বিলের সংশোধনী প্রস্তাবে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি ছিল না। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটিও পরিচালক পদের মেয়াদ নিয়ে কোনো সংশোধনী আনেনি।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, পরিচালকরা হচ্ছেন ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা। কোনো পরিচালক সুপারিশ না করলে ব্যাংক ঋণ মিলবে না। চেয়ারম্যান-পরিচালকের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক শেষ। তিনি বলেন, আইনের কোনো ধারা অর্থমন্ত্রী সংশোধনীতে আনেননি। যে সেকশন সংশোধনের জন্য সংশোধনী কমিটি কোনো সুপারিশ করেনি, সেখানে একজন সরকারি দলের সদস্য কোন আইনে এই সংশোধনী আনলেন? তিনি এটা পারেন কিনা?

মুজিবুল হক বলেন, ‘মনে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে কনভিন্স করে সরকারি দল করেন এমন অনেক ব্যাংকের পরিচালকের সুপারিশে এটা আনা হয়েছে। সেটা হলে আমরা আমাদের সব সংশোধনী প্রত্যাহার করলাম। কারণ এর থেকে বড় অন্যায় আর হতে পারে না। যেখানে ব্যাংক লুটপাট করা হচ্ছে, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে, আর বাংলাদেশ ব্যাংক বসে বসে তামাক খায়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যান। আপনারা দেখছেন না। আপনারা আছেন কাউকে ফেভার করার জন্য। পরিচালকের মেয়াদ ১২ বছর করার এই প্রস্তাবের আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ব্যাংক মালিকদের অনুদান দেওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘তাঁরা এই টাকা দিয়ে পত্রিকার প্রথম ও শেষ পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বড় বড় ছবি ছাপায়। তাঁরা তো একসময় খালেদা জিয়ার ছবিও এভাবে ছাপাত। সেটা তো প্রকাশ করেন না। এদের চরিত্র একই। এরা আপনার হাতের কলকি খেয়ে চলে যাচ্ছে। আপনাদের হাতে গন্ধটা থেকে যাচ্ছে। এখনও সাবধান হন। এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসেন।’

ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক কারা এই প্রশ্ন তুলে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আমরা তার লিস্ট চাই। আমরা এই ভাগ্যবানদের সংসদে দেখতে চাই। সমস্ত দলীয় কর্মী ও আত্মীয়স্বজনকে স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়। তারা ব্যাংকে যায় শুধু লোন নেওয়ার জন্য। ১০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ২ কোটি নিজে নিয়ে নিল। এক দিনে ধনী হয়ে গেল। যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এখানে হরিলুট চলছে। আমরা তাদের মেয়াদ কমানোর প্রস্তাব করছি না। এদের মেয়াদ আজীবন করে দেন। আমি এখন প্রস্তাব আনলাম। এই পরিচালকরা আজীবন থাকবে। আল্লাহ যতদিন হায়াত রাখছেন আপনারা খাইতে থাকেন। আমরা দেখতে থাকি।’

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, এই আইনে সংশোধন আনা হচ্ছে শুধু ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর খবরদারি করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কে হবেন, ডেপুটি গভর্নর কে হবেন– এগুলো তারা নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকারদের কাছে সরকার জিম্মি হয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, সরকার তাদের প্রিয় পরিচালকদের কীভাবে পদে রাখবে সেটা ভুলে গিয়েছিল। এ কারণে পরে এই সংশোধনী আনা হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে তা সঠিক প্রক্রিয়া নয়।

বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, খেলাপি ঋণ ১৪ বছরে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। সরকারি ব্যাংকের শাখা দ্বিগুণ বেড়েছে। ব্যাংকের আমানত ৭ গুণ বেড়েছে। বছরওয়ারি মুনাফা বেড়েছে ৮ গুণ। তিনি আশা করেন, তাঁর এই বক্তব্যে ভুল বোঝাবুঝির কিছুটা অবসান হবে।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে গেলে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা হইচই করেন। তখন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আগে সংসদ সদস্যকে সংশোধনী প্রস্তাব তুলতে দিন। এরপর বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। আহসানুল ইসলাম সংশোধনী প্রস্তাব তোলার পর স্পিকার তাঁর রুলিংয়ে বলেন, এখানে বিলে কোনো নতুন ধারা যুক্ত করা হয়নি বা এমন কোনো নতুন দফাও যুক্ত করা হয়নি। এটি অপ্রাসঙ্গিক নয়।

স্পিকারের বক্তব্যের পর বিরোধী দলের সদস্য ফখরুল ইমাম কথা বলতে চাইলে স্পিকার মাইক না দিয়ে বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য এটা আমার রুলিং। আপনি এ বিষয়ে আর আপনার কিছু বলার নেই।’ ফখরুল ইমাম এ সময়ে আবারও হাত তুললে জবাবে স্পিকার বলেন, আপনাকে সুযোগ দেওয়ার কোনো বিধান নেই। আমি দিয়েছি আমার ব্যাখ্যা।
স্পিকার রুলিংয়ের পর অর্থমন্ত্রীকে ফ্লোর দেন। এ সময় মাইক ছাড়াই বিরোধী দলের সদস্যরা চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। পরে স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের বলেন, ‘আমরা বিধির বাইরে কিছু করব না।’ তবে তখনও বিরোধী দলের চিৎকার-চেঁচামেচি অব্যাহত থাকে।
এক পর্যায়ে স্পিকার সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে দিলে জাতীয় পার্টি ওয়াকআউট করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *