সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক
দেশে একের পর এক ঘটছে গণপিটুনিতে প্রাণহানির ঘটনা। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। ভুল-সঠিক না ভেবে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা থেকে আইন তুলে নিচ্ছে নিজের হাতে। গুজব ছড়িয়েও অনেক ক্ষেত্রে উত্তেজিত করে তোলা হয় লোকজনকে। সর্বশেষ গত রোববার ঢাকা শিশু হাসপাতালে সাইকেল চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৯৬২ জন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জড়িতরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধেরও অভাব রয়েছে। আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না দেখিয়ে নিজেরাই প্রতিরোধ করতে চাইছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এলে এ ধরনের সহিংসতা কমবে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে সাইকেল চোর সন্দেহে মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করে অন্তত ১০ জন। বারবার প্রাণভিক্ষা চেয়েও তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি মামুন। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে গণপিটুনির বেশিরভাগ ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার হয় না। বিচার পায় না নিহতের পরিবার। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মধ্যম কাঞ্চনার ঘোষঘাটা এলাকায় খুঁটিতে বেঁধে গণপিটুনিতে ইছাহাক নামে একজনকে হত্যা করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, ইছাহাকসহ দু’জন একটি বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিল। অন্যজন পালিয়ে গেলেও ইছাহাক ধরা পড়ে। তাকে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বেঁধে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় হত্যা মামলা করে। জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৯৫৪ জন। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে নিহত হয়েছেন আটজন। সর্বমোট ৯৬২ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন ঢাকা বিভাগে, ৪২৩ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২৩৬, খুলনায় ১১৮, বরিশালে ৩১, সিলেটে ২৮, রংপুরে ৩১ এবং ময়ময়সিংহ বিভাগে ১০ জন নিহত হয়েছেন।
২০১৯ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘শিশুদের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানো হয়। ওই বছর ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওইদিন সকালে তিনি উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পর স্কুল প্রাঙ্গণে অভিভাবকদের সামনে পড়েন। তাঁরা রেনুকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করেন। এরই মধ্যে স্কুলসংলগ্ন কাঁচাবাজার ও আশপাশ এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে– স্কুলে ছেলেধরা আটক করা হয়েছে। লোকজন ছুটে এসে রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর একটি রিট করা হয়েছিল হাইকোর্টে। গুজব ছড়ানো ও গণপিটুনির ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পাঁচ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন হাইকোর্ট।
গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির প্রবেশমুখে মোবাইল ফোন ছিনতাইকারী সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জানুয়ারি মারা যান তিনি। এ ঘটনায় নগরের পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। গত বছর ১৬ মে রাতে ঢাকার নবীনগরে যাত্রীবাহী বাসে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়ায় এক যুবক আহত হন। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পরদিন সকালে মারা যান। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় আসামি অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে হত্যা মামলা হয়।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এবং পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, সন্দেহভাজন অথবা অপরাধী হিসেবে মানুষ অনেক সময় জনরোষের মুখোমুখি হয়। তবে সমাজে নেতিবাচক ধারণার অনেকগুলো কারণও আছে। অপরাধী অনেক সময় ধরা পড়ে না, বিচারের আওতায় আসে না। এ কারণে আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না দেখিয়ে অনেকে নিজেরাই প্রতিরোধ করতে চায়। এভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে বিচার ব্যবস্থায় জনগণের আস্থার যে সংকট আছে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। পরিস্থিতি মোকবিলা করতে হবে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে।
মানবাধিকার কর্মী আইনজীবী সালমা আলী বলেন, চুরি করার জন্য একজনকে মেরে ফেলতে হবে? যদি সামাজিক মূল্যবোধের অভাব থাকে, নৈতিকতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকে তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সবমিলিয়ে অস্থিরতা রয়েছে সমাজে। সামাজিক নীতি-নৈতিকতা নিয়ে কাজ করে এমন লোকেরও অভাব আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) ফারুক হোসেন বলেন, গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে হত্যা মামলা নেওয়া হয়। তদন্ত করে এবং ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরা থাকলে ফুটেজ সংগ্রহ করে জড়িতদের শনাক্ত করার মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।