সুবর্ণবাঙলা প্রতিবেদক
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে শ্রমিকের মজুরি হিসেবে প্রকৃত অর্থের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি টাকা বিতরণের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে মজুরিভোগীদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা চলে গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি অধিদপ্তরের আওতায় ‘অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি)’ দ্বিতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জেলার ১০টি উপজেলার মোট ৯ হাজার ৮৪৬ জন উপকারভোগীর শ্রম মজুরি গভর্নমেন্ট টু পারসন (জিটুপি) পদ্ধতিতে পরিশোধ করা হয়। মজুরিভোগীরা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের মাধ্যমে সাত দিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত কাজের মজুরি পেয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, উপকারভোগীদের কাছে ৮ কোটির কিছু বেশি টাকা পাঠানোর কথা থাকলেও অধিদপ্তরের ভুলে ৮২ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকার বেশি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ জুন এ ঘটনা ঘটে।
পাওনার চেয়ে অনেক বেশি টাকা পেয়ে দরিদ্র সুবিধাভোগী অনেকেই ঘাবড়ে যান। আবার বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যাশ আউট করে নেন অনেক সুবিধাভোগী। টাকা পাঠানোর পর বিষয়টি অধিদপ্তরের দৃষ্টিতে এলে ওই অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করতে নগদকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের নির্দেশে এসব গ্রাহকের একটি অংশের লেনদেন বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, অটো ডিভাইসে ডেসিমল পয়েন্ট (দশমিক) ভুলে উঠে গেছে। সে জন্য অতিরিক্ত টাকা উপকারভোগীদের কাছে চলে গেছে। অতিরিক্ত টাকার ৮০ শতাংশই মাঠ পর্যায়ে তোলা হয়ে গেছে। ১০ উপজেলায় এ সমস্যা হয়েছে। এ টাকা সমন্বয় করা হবে। ইউএনওরা এ টাকা তুলে আবার জমা দিয়ে দেবেন। সব টাকা ফেরত পাওয়ার পর শিগগিরই সবার অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো চিঠিপত্র রয়েছে। এ ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি দপ্তরে যেসব নথি পাঠানো হয়েছে, তা দেখেই নিশ্চিত হওয়া গেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিপ্তরের ডাটা এন্ট্রির সময়েই এই ভুল হয়েছে। অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, তাদের নিজেদের ডাটা এন্ট্রির ভুলে বেশি টাকা বিতরণ করা হলেও এখন সেটি আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে সুবিধাভোগীরা মনে করছেন, নগদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা পেয়েছেন। অনেকে সেই টাকা খরচ করে ফেলেছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে নগদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র বলেন, সরকার যখন কোনো টাকা বিতরণ করে তখন কোন অ্যাকাউন্টে কত টাকা যাচ্ছে, সেটি গ্রাহকের প্রাপ্য কি প্রাপ্য নয়, অথবা টাকা কম না বেশি গেল, সে সম্পর্কে তাদের কোনোই ধারণা থাকে না। কারণ অর্থ বিতরণের কোনো পর্যায়েই তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে না। সরকারি বিতরণের ক্ষেত্রে বিতরণকারী সংস্থা শুধু তাদের নেটওয়ার্কটি ব্যবহার করে। এর বাইরে তাদের কিছুই করার থাকে না।
মোবাইল অ্যাকাউন্টে সরকারি অর্থ বিতরণের প্রক্রিয়া
মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে যে কোনো সরকারি ভাতা, অনুদান, উপবৃত্তি বা সরকারি সহায়তা বিতরণের ক্ষেত্রে সরকার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এতে বিতরণকারী সংস্থা আগে সুবিধাভোগীদের মোবাইল আর্থিক সেবার নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, টাকার পরিমাণ এবং আরও কিছু তথ্য দিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরি করে।
পরে সেই ডাটাবেজের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সরকারের সমন্বিত বাজেট ও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতিতে পাঠানো হয়। এটি আইবাস প্লাস নামে পরিচিত। আইবাস মূলত একটি ইন্টারনেটভিত্তিক সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ বিভাজন ও অর্থ অবমুক্তি করার প্রক্রিয়া করা হয়। আইবাসে সুবিধাভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর যাচাই করে একটি টোকেন তৈরি করা হয়। এরপর সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে সরকারের এজি অফিস থেকেও সংশ্লিষ্ট বাজেট বরাদ্দবিষয়ক অনুমোদন পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেটি অনুমোদিত হলে সোনালী ব্যাংকে পাঠানো হয়। সোনালী ব্যাংক ইলেকট্রনিক মানি (ই-মানি) জেনারেট করে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়।
মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা এই প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়েই জড়িত থাকেন না। শুধু গ্রাহকের কাছে টাকা যাওয়ার পরই তারা বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। তবে মোট কী পরিমাণ টাকা বিতরণ করা হতে পারে, সে বিষয়ে তাদের কেবল ধারণা দেওয়া হয়।
কীভাবে ঘটল
দফায় দফায় যাচাই-বাছাইয়ের পরও কয়েক হাজার লোককে সরকারের কোটি কোটি টাকা যেভাবে অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমানের স্বাক্ষর করা চিঠিতে (স্মারক নম্বর- ৫১.০১.০০০০.০১৩.০৯৬.০২২.২৩-৩৬৪, তারিখ: ২০/০৬/২০২৩) ৯ হাজার ৮৪৬ জন কর্মীকে শ্রম মজুরি হিসেবে ৮২ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪২৭ টাকা বিতরণের তালিকা চূড়ান্ত করে তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসানের প্রতিস্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হয়। তারও আগে কয়েক ধাপে তৈরি হয় তালিকা।
প্রকল্পের তালিকায় এই দফায় ছিল ময়মনসিংহ সদর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া; বরিশাল সদর, পটুয়াখালীর বাউফল, খুলনার দিঘলিয়া, বাগেরহাটের মোংলা ও কচুয়া, মাগুরার মহম্মদপুর এবং পিরোজপুর সদর উপজেলা।
এসব উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের শ্রমিকদের তথ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে পাঠান। তালিকা অনুসারে শ্রমিকদের জনপ্রতি প্রতিদিনের মজুরি হিসাবে ৪০০ টাকা করে পাওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এরই মধ্যে নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তারা দেখেন, ডাটা এন্ট্রির সময় দশমিক সংক্রান্ত জটিলতায় অঙ্কের এ বড় ভুলটি হয়েছে। তালিকায় থাকা শ্রমিকদের একটি বড় অংশের সাত দিনের মজুরি হিসাবে ২ হাজার ৮০০ টাকা পাওয়ার কথা। সঙ্গে সরকারের দিক থেকে ক্যাশআউট চার্জ হিসাবে আরও ১৯ দশমিক ৬ টাকা যোগ করা হয়। ফলে তাদের মোট প্রাপ্য দাঁড়ায় ২ হাজার ৮১৯ দশমিক ৬ টাকা। উপজেলা পর্যায় থেকেও এ অঙ্কই অধিদপ্তরে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছে সূত্র।
কিন্তু শ্রমিকদের নগদ অ্যাকাউন্টে ২৮ হাজার ১৯৬ টাকা জমা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, দশমিক উঠে যাওয়াসংক্রান্ত জটিলতা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকেই। ডাটা এন্ট্রি দেওয়ার সময়ই এ জটিলতা হয়। দশমিক না থাকার কারণেই এখানে ওই শ্রমিকরা প্রতিজন ২৫ হাজার ৩৭৬ টাকা ৪০ পয়সা বেশি পেয়েছেন।
আবার এমনও পাওয়া গেছে, কোনো শ্রমিকের প্রাপ্য ছিল ১২ হাজার টাকা। সরকারের দিক থেকে ক্যাশআউট হাজারে ৭ টাকাসহ শ্রমিকের মোট প্রাপ্য দাঁড়ায় ১২ হাজার ৮৪ টাকা। তবে তিনি এ টাকাই পেয়েছেন। কারণ, এই শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরির পর কোনো দশমিক ছিল না।
সূত্র জানিয়েছে, এক শ্রমিকের মজুরি হিসাবে ১৬ হাজার ২০০ টাকা প্রাপ্য ছিল। সরকারের অংশের ক্যাশআউট চার্জ যোগ করার পর তাঁর প্রাপ্য অঙ্ক দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৩১৩ দশমিক ৪০ টাকা। পরে দেখা গেছে, ওই শ্রমিককে ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৩৪ টাকা পাঠিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। তবে শেষ অর্থ প্রদান আটকে দেওয়ায় অনেক শ্রমিক মজুরি পাননি।
তালিকায় থাকা শ্রমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের ৩ হাজার ১৭২ দশমিক শূন্য ৫ টাকা পাওয়ার কথা ছিল বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, দশমিক তুলে দেওয়ায় ওই অঙ্ক হয়ে গেছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ২০৫ টাকা। তবে মোবাইল আর্থিক সেবার বিধান অনুসারে একটি অ্যাকাউন্টে কোনো অবস্থাতেই ৩ লাখ টাকার ওপরে থাকতে পারবে না। ফলে যাদের ৩ হাজার ১৭২ দশমিক শূন্য ৫ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তাদের কারও অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ঢোকেনি। এই টাকা আবার বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত গেছে।
সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ
প্রাপ্যের চেয়ে বেশি মজুরি চলে যাওয়ার খবরে বিভিন্ন এলাকায় তোলপাড় শুরু হলে বিষয়টি নজরে আসে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের। সঙ্গে সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট সব অ্যাকাউন্টে অর্থ প্রদান বন্ধ করতে নগদকে নির্দেশনা দেয়।
কত অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে বা এখন কত অ্যাকাউন্ট বন্ধ রয়েছে– এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগদ তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তারা বলে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরই বলতে পারবে। এ বিষয়ে তথ্য দেওয়ার কোনো এখতিয়ার তাদের নেই।