সুবর্ণবাঙলা ওয়েবডেস্ক
এক যুগেও শেষ হয়নি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। পুরোনো ছবি
রাজধানীর উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের সংযোগ, ট্রাফিক ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি এবং যোগাযোগ ও যানবাহন চলাচলে খরচ কমাতে ২০১১ সালে নেওয়া হয় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। তিন বছরের প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে। এরপর সময় বাড়ে ২০১৬ পর্যন্ত। এখন ২০২৪ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। শুরু থেকেই শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে চলা চার লেনের এই প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৬৩ ভাগ। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো, আর্থিক অনিশ্চয়তা আর কয়েকবার নকশা পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় গিয়ে ঠেকেছে ১৪ হাজার কোটিতে। এর পরও যথাসময়ে কাজ শেষ করতে না পারার পাশাপাশি ব্যয় আরও বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পটির সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। মূল পথ ১৯ কিলোমিটার। বাকি ৩১ কিলোমিটারে রয়েছে ২৭টি র্যাম্প। তিন ভাগে এর নির্মাণকাজ চলছে। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রকল্পটির ব্যয় প্রথমে ধরা হয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। কিন্তু পরে ভূমি অধিগ্রহণ, নকশা বদল, অর্থ সংস্থানের জটিলতায় সময় বাড়ে চার দফা। এতে ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম শাখাওয়াত আকতার জানান, তিন ভাগের মধ্যে বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত মোট দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশের অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ। দ্বিতীয় অংশ বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার অংশের অগ্রগতি ৫৪ শতাংশ। তৃতীয় অংশ মগবাজার-যাত্রাবাড়ী হয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার। এ অংশের অগ্রগতি ৫ শতাংশ।
তিনি বলেন, ‘নকশা বদলের কারণে সময়ের পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে।’
গত শনিবার প্রকল্পের বিমানবন্দর অংশ পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এয়ারপোর্ট-ফার্মগেট অংশ আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। এই এক্সপ্রেসওয়ের পুরো কাজ শেষ হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমবে। পাশাপাশি এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।’
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ইতালি-থাই ৫১ শতাংশ, চীনা শেয়ডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল গ্রুপ ৩৪ শতাংশ এবং আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনের ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে। তবে বিনিয়োগের টাকা জোগাড় করে চুক্তি সইয়ের পর কাজ শুরু করতেই লেগেছে ছয় বছর। উড়াল সড়ক চালুর পর ২২ বছর টোল আদায় করে বিনিয়োগের টাকা মুনাফাসহ তুলে নেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, ৬৮ টাকা ডলারের হিসাবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের সঙ্গে প্রথম চুক্তিবদ্ধ হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরুর পর জায়গা বুঝে না পাওয়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল। মূলত পিপিপি প্রকল্পের ঝুঁকি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নেওয়ার কথা থাকলেও এক পর্যায়ে ডলারের ৭৮ টাকা মূল্য ধরতে সরকারের কাছে দাবি জানায় তারা।
জানা গেছে, প্রথমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের দুটি নকশা সরকারের কাছে জমা দেয়। একটি বক্স, অন্যটি আই গার্ডার। এর মধ্যে প্রথমটি পছন্দ হয় সরকারের। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডলারের রেট বাড়ানোর দাবি জানালে সরকার আই গার্ডারের প্রকল্পটি চূড়ান্ত করে তাদের এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। তবুও নির্মাণকাজের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।
জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের দেওয়া জমিতে এই উড়াল সড়কের মহাখালীর র্যাম্পে ওজন ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব নয় বলে জানায় পিপিপি নির্মাণাধীন এক্সপ্রেসওয়ের বিনিয়োগকারী। মেট্রোরেলের এমআরটি-৫ (দক্ষিণ) লাইনের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইনমেন্ট সাংঘর্ষিক। কারওয়ান বাজার এলাকায় প্রয়োজন হবে গভীর খননের। এ জন্য রাস্তা বন্ধ রাখতে হবে তিন মাস। এ কাজে ৬ মিলিয়ন ডলার এবং ২৩৮ দিন বাড়তি সময় চায় বিনিয়োগকারীরা। এতে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়।
প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে একসময় কাজ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক। বলেন, ‘পিপিপি ভিত্তিক প্রকল্প ৪২ মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সক্ষমতার অভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ সময়মতো শেষ হয়নি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এয়ারপোর্ট এলাকা ও কারওয়ান বাজারে এমআরটি লাইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় কয়েকবার এই প্রকল্পের নকশা বদলানো হয়েছে।
বেশ কয়েকবার প্রকল্পের রুট (অ্যালাইনমেন্ট) পরিবর্তনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্মাণে সমন্বয় না থাকা ও সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় সিটি করপোরেশন, রাজউক, মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক কর্তৃপক্ষ, আর্মি ও নৌবাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রকল্প নির্মাণে আপত্তি আসে। মূলত পরিকল্পনার অভাব ও সমন্বয় না থাকায় প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ঢাকা যানবাহন কো-অর্ডিনেশন অথরিটি- ডিটিসিএ কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা না থাকায় এ প্রকল্প নিয়ে নানা দুর্গতি চলছে।
ধারণা করা হচ্ছিল, প্রতিদিন এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ঢাকা নগরীতে না ঢুকেই বিভিন্ন অঞ্চলের ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নকশা প্রণয়ন, ঢাকার দুই অভিভাবক সংস্থা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ডিটিসিএর মধ্যে সমন্বয়হীনতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে আবারও জটিলতা দেখা দেয়। সর্বশেষ গত ৮ মে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় জটিলতা নিরসন হয়।
ওই বৈঠকে উপস্থিত স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ধানমন্ডি ও পুরান ঢাকার মানুষ প্রকল্পের সুবিধা পাবেন না, তা প্রধানমন্ত্রী মেনে নিতে পারেননি। তাই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়ার পর র্যাম্প নির্মাণ নিয়ে জটিলতার অবসান করেছেন তিনি।’
জানা গেছে, বিনিয়োগকারীর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, সবচেয়ে দীর্ঘ র্যাম্পটি নির্মিত হবে এফডিসি রেলগেট থেকে হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্ক, হাতিরপুল, কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পলাশী পর্যন্ত। এক্সপ্রেসওয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, উড়াল সড়কে চলাচল করা যানবাহনের ১৮ শতাংশই ব্যবহার করবে এই র্যাম্প। র্যাম্পের একটি মুখ কারওয়ান বাজারের নামবে। অন্যটি যাবে পলাশী।
এদিকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ৩৩২ নম্বর পিলারে ভয়াবহ নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়ে। নির্মাণকাজ মানসম্মত না হওয়ায় পিলারটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।
(সৌজন্যে: কালবেলা)