কূটনৈতিক প্রতিবেদক
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ উদ্দেশ্যে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) ও অ্যাকুইজিশন ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্টের (এসিএসএ) খসড়া দিয়েছে ওয়াশিংটন। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ দুটি চুক্তি করার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক চাপ ও সার্বিক বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দেশের বিশিষ্টজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিশিষ্টজনের সঙ্গে কথা বলেন। সাবেক কূটনীতিক, নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক সদস্য ও বিশ্লেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্টরা এতে উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি জিএসওএমআইএ ও এসিএসএ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের মূল অগ্রাধিকার হচ্ছে দেশের মানুষের মঙ্গল। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের অগ্রাধিকার। নির্বাচনের আগে বিলাসবহুল চুক্তি করব বলে আমার মনে হয় না।
দুর্নীতির অর্থ জব্দ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি দুর্নীতি বন্ধে সাহায্য করে, আমরা খুবই খুশি হবো। কারণ, তাদের দেশে একটি আইন আছে, বেশি টাকা নিয়ে গেলে কাজের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাদের নাগরিক হওয়া যায়। এটা শুধু তাদের দেশে না, অন্য দেশেও এই নিয়ম আছে। আর আমাদের দেশের যারা দুর্নীতি করে টাকা নিয়ে যান, তারা যদি জব্দ করে, আমরা খুশি হবো। আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজন সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত– সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তাদের ভিয়েনা সনদসহ অন্যান্য যে আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। সাংবাদিকরা কী ধরনের প্রশ্ন করবেন, রাষ্ট্রদূতরা কোনো উত্তর দিলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো আলোচনায় আসে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন বলেন, আলোচনায় উঠে আসে– যখন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যে ভিয়েনা সদন ভঙ্গ হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি এক প্রকার উত্তর দিয়ে পার পেয়েছেন। কিন্তু আবারও পাল্টা সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করা উচিত ছিল– অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে ভিয়েনা সনদ ভঙ্গ হয়েছে কিনা। এ বিষয়ে মতামত আসে, সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকার আলোচনা করতে পারে। সেই সঙ্গে তাদের ভূমিকা অবহিত করার মতো কর্মসূচি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
বৈঠকে বিশিষ্টজনের পক্ষ থেকে পরামর্শ আসে– গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে আরও যোগাযোগ বাড়ানোর। তাদের দিক থেকে প্রশ্ন আসে– যদি কখনও চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়, তবে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিশিষ্টজন দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের কূটনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ, মিয়ানমারের চিন প্রদেশ ও বাংলাদেশের বান্দরবানকে সামনের দিনগুলোতে হুমকিতে ফেলতে পারে। এ জন্য এখন থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় যে অস্বীকারের প্রবণতা রয়েছে, তা থেকে বের হয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক এলাহি চৌধুরী বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা কখনোই ভালো ফল এনে দিতে পারে না। তখন বিষয়গুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি। তবে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর তো ঠিকই বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রায় বন্ধ হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো নিয়ে আমরা মতবিনিময় করেছি। সেখানে উঠে এসেছে– বর্তমান ও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বা হয়েছে। পশ্চিমা পক্ষ থেকে সেই দেশগুলো নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কেন এত আগ্রহ, সেই প্রশ্ন উঠেছে। তাদের আগ্রহ ভূরাজনৈতিক নাকি অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণ, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে সবাই একমত হয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোকে কেউ ভালোভাবে দেখছেন না।
কুকি-চিন নিয়ে এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, হঠাৎ করে তাদের বেড়ে ওঠা তৎপরতার পেছনের কারণ খোঁজার কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে কোনো আঞ্চলিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা, কী কারণে তাদের তৎপরতা হঠাৎ করে বেড়েছে, কোন গোষ্ঠী অস্থিরতা সৃষ্টিতে এমনটি করছে, তা খোঁজার কথা বলা হয়েছে।
বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলাপ নিয়ে ড. মোমেন বলেন, তারা তাদের বক্তব্য ও পরামর্শ দিয়েছেন। একটি পরামর্শ আপনাদের জন্যও দিয়েছেন। বলেছেন যে, আমাদের এখানের সাংবাদিকরা যখন প্রশ্ন করলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে, আপনি কি জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছেন? তখন তিনি বলেছেন, আমাদের দেশ সম্পর্কেও কত লোকে কথা বলে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে বলা উচিত ছিল, আপনি জেনেভা কনভেনশনের ৪১ ধারা লঙ্ঘন করেছেন কিনা? সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করেননি। কিংবা যখন বাংলাদেশে ১০ বছরে ৭৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন– এটি নিয়ে তারা যখন কথা বলেন, আমাদের কোনো সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেননি, আপনার দেশে কতজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সে কারণে আমাদের এখানের একজন (বিশিষ্ট ব্যক্তি) প্রস্তাব দিয়েছেন, কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, সাংবাদিকদের তার একটা প্রশিক্ষণ দরকার। এভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় হয়। আলাপটা খুবই উন্নতমানের গুণগত দিক থেকেও ভালো। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারা আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
তারা কী নির্দেশনা দিয়েছেন– জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একটা হচ্ছে আগামী দিনে আমরা কীভাবে কূটনীতিকদের ম্যানেজ করব, তারা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। কূটনীতিকদের কীভাবে ম্যানেজ করতে বলেছেন– প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকরা একটু আগ বাড়িয়ে কথা বলেন। অন্য কোনো দেশে এভাবে বলেন না। আলোচনায় যেসব কূটনীতিক ছিলেন, তারা বলেছেন– আমরা তো বহু বছর বিদেশে চাকরি করেছি; কিন্তু বাংলাদেশের মতো এমন অবস্থা কোথাও দেখিনি।
এ সময় মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে ঐতিহাসিকভাবে এটা হয়ে আসছে, এ জন্য বিভিন্ন মহল দায়ী। তবে এই সংস্কৃতি এক দিনে পরিবর্তন করা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু আমি মনে করি, এখন সময় হয়েছে, এর পর একটা সেমিনার করব।
আগামী সপ্তাহে দুই কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন খুব আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে খুবই শক্তিশালী সম্পর্ক করতে চান তিনি।