শাওন মাহমুদ
নিদির্ষ্ট ভৌগোলিক অবস্থানে সুদীর্ঘকাল বসবাসের মধ্যদিয়ে বিভিন্ন সমগোত্রীয়দের সমন্বয়ে একটা জাতির সৃষ্টি হতে পারে। বাঙালি জাতি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গঙ্গাঋদ্ধি থেকে যেমন আজকের বাংলাদেশের উদ্ভব। তেমনি এই অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন গোত্রের সমন্বয়ে বাঙালি জাতির সৃষ্টি। খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে আজ পযর্ন্ত বাংলাদেশের বিবর্তনের ধারায় ‘‘গঙ্গাঋদ্ধি নিয়ে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-পুরাণ-উপাখ্যানে উল্লেখিত না হলেও কার্তিয়াস, দিওদোরাস, প্লুতার্ক প্রমুখ গ্রিক লেখকদের ইতিবৃত্তে, স্ট্রাব ও টলেমির ভূগোলবৃত্তান্তে আর ভার্জিলের মহাকাব্যে গঙ্গাঋদ্ধি নামটি ভাস্বর হয়ে আছে’’।
তৃতীয় শতকের শেষে বা চতুর্থ শতকের প্রথমার্ধে গুপ্তদের আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত বরেন্দ্রাঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। চতুর্থ শতকেই বাংলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। ষষ্ঠশতকের প্রথমার্ধ পযর্ন্ত উত্তর বাংলায় গুপ্তদের শাসন অব্যহত ছিলো। এভাবে পাল, খড়গ, সেন, তুর্কী, মোঘল, পাঠান, বৃটিশ প্রভৃতি ঘুরে বাঙ্গালির বাংলাদেশ। বলাহয়ে থাকে এ অঞ্চলে যিনি একবার এসেছেন তিনি আর ফেরত যেতে পারেননি। এখানেই থেকে গেছেন। এখানে যেমন রয়েছে কুল, ভীল, সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসির মিশ্র রক্ত। তেমনি মিশে আছে মঙ্গলয়েড, অট্রিলয়েড, আফ্রিকান জাতিগোষ্ঠির রক্তের সংমিশ্রন। জীবজৈবিকীর এমন মিশ্রন যেমন কালের বির্বতনে আমাদের একটা মিশ্র বিশিষ্ট বর্ণের জাতিতে চিহ্নিত করেছে। তেমনি বিভিন্ন ধর্মীয় কৃষ্টি সংস্কৃতিরও মিশ্রন রয়েছে আমাদের ভাষায়, সংস্কারে। বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে কালে কালে সুবিধাবাদী উচ্চশ্রেণির মানুষ এ অঞ্চলের মানুষকে সামাজিক ভাবে বিভক্ত করে লেখেছে শোষনের সুবিধার জন্যে।যার প্রবলতা ছিলো পাকিস্তান কালাবধি। বাঙলা ভাষার উপর আঘাতে এ অঞ্চলের মানুষ প্রথম নিজেরা আবিস্কার করলো তারা, ধর্মে ভিন্নতা সত্বেও আসলে পরস্পর আত্মীক সম্পর্কে একই বন্ধনে আবদ্ধ। ভাষাআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাই আমাদের জাতীয়তা সংহত ও দৃঢ়বদ্ধ হতে থাকল।তাই বলা হয়ে থাকে বা, বলা যায় ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনার বীজমন্ত্র।এ দিনের আনন্দ,বেদনা, মাহাত্ম্য যা-ই বলিনাকেন তা নির্জলা অসাম্প্রদায়িক। আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও স্বার্বজনীন। তবে তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করে তারও স্বার্বজনীনতা প্রশ্ন বিদ্ধ করার প্রয়াস রয়েছে।
সম্রাট আকবরের প্রচলিত ফসলি সন (ফসল তোলার হিসেবকে গুরুত্বদিয়ে প্রচলিত) ঐ সময় যেমন কারো কারো কাছ আসতো আনন্দের হয়ে। আবার কারো কারো কাছে আসতো আতঙ্ক হয়ে। খাজনা আদায়কারী জমিদার, তহশীলদার, দোকনদার এই দিনে থাকতেন আনন্দে। অন্যদিকে করদাতা কৃষক, বকেয়া খরিদদার ফসল মন্দা হলে থাকতেন চিন্তিত, আতঙ্কিত। কালের বিবর্তনে সেই দিনই জাতি গঠনের মানসে অন্য আমেজে পালন করা হয়। কিন্তু আনন্দ ও আতঙ্ক গ্রস্থ ভাগ দুটি রয়েই গেছে। শুধু প্রেক্ষাপট ভিন্ন। পয়লা বৈশাখে এখন আনন্দিত হন দেশ প্রেমিকগন। জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ করনের একটা উৎসবের জন্য। আর আতঙ্কিত হয় সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি সম্পন্ন কুপমণ্ডুকরা।
সার্বজনীন উৎসব সবসময়ই সব কালে সব দেশে মঙ্গল জনক। মঙ্গল জনক এই অর্থে-এইসব উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে হৃদ্যতা বাড়ে, ঐক্য ও নৈকট্য বাড়ে। এখানে কোনো ধর্মীয় বাধাবিপত্তি থাকেনা। আপনার পাশের লোকটি হিন্দু কি মুসলিম, অথবা বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান এসবে কারও চিন্তায় থাকেনা। সবার মনে থাকে নির্মল আনন্দ। উৎসব, দেশ, ভাষা তখন যেনো সবার কাছে শীতল হাওয়া সবাই তা গ্রণ করি। মায়াবী জোৎস্না সবাই তাতে অবগাহন করি। ফুলের ঘ্রাণ সবাই তা গ্রহণ করি। ঝর্ণার ধারা সবাই তাতে শীতল হই। সব কিছু ছাপিয়ে দেশ প্রেমে উদ্বোদ্ধ হই। এ কি সার্জনীণ মঙ্গল নয়?
কেউ যদি মঙ্গল শোভা যাত্রকে মনে করেন ব্যক্তির মঙ্গল হবে বা, এরকম উদ্দেশ্যেই বা, মঙ্গলের জন্যই এই শোভা যাত্রা। তাহলে তিনি একজন মহামূর্খ। আর, মূর্খ সবসময়ই বিপদজনক! মনে রাখা উচিৎ এই মঙ্গল স্রেফ ভ্রাতৃত্বের মহা মিলনের, আনন্দের। অনেকে শোভাযাত্রার মটিফ নিয়ে সাম্প্রদায়িক রঙ দিতেও ছাড়েননা। আসলে এর দ্বারা আমাদের আশেপাশের সকল প্রানের বা প্রকৃতির যা আমাদের সবর্ত্র পরিচিত তাদের উপস্থিতি বুঝাতে এসব ব্যবহার করা হয়। সব কিছু নিয়েইতো সার্বজনীনতা।