ভেজাল খেজুর গুড় তৈরির অজানা তথ্য পাওয়া গেল

অর্থ ও বাণিজ্য আইন আদালত জাতীয়

সুবর্ণবাঙলা প্রতিবেদন

মাদারীপুরের শতাধিক গ্রামে রয়েছে ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরির কারখানা। রং, চিনি আর বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে প্রকাশ্যেই তৈরি হচ্ছে খেজুরের গুড়; যা খাঁটি বলে ছাড়া হচ্ছে মাদারীপুরের হাটবাজারে। প্রতি কেজি গুড় বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে আড়াইশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকায়। প্রতি বছর শীত মৌসুম এলেই অধিক মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ীরা এ অসৎ কাজে লেগে পড়েন দীর্ঘদিন ধরে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দাবি, এ গুড় খেলে হতে পারে কিডনি নষ্টসহ ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, অভিযোগ পেলেই নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চাতালে জ্বলছে আগুন। আখের গুড় ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে খেজুরের গুড়। তার সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে বিষাক্ত হাইড্রোজ ও সালফার। মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুরের সরদারকান্দি গ্রামের দৃশ্য এটি। এখানে কয়েকটি বাড়িতে বসেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজাল গুড়; যা ছড়িয়ে পড়ছে হাটবাজারে। একই অবস্থা জাফরাবাদ, তাল্লুক, ঘটমাঝি, ঝিকরহাটি, কেন্দুয়া, বাজিতপুর, কলাগাছিয়া, পেয়ারপুর, মোস্তফাপুর, শিবচরের বিভিন্ন গ্রামে, কালকিনি, ডাসারসহ জেলার অন্তত শতাধিক এলাকার। সামান্য খেজুর রসের সঙ্গে পানি, চিনি আর রংয়ের মিশ্রণে তৈরি করা হচ্ছে গুড়; যা দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটি আসল, আর কোনটি নকল। এসব গুড় কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।

বিক্রেতারা বলছেন, খাঁটি গুড় তৈরি হলে ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। তাই বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল গুড়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, ভেজাল গুড় তৈরি বন্ধ করা না গেলে হতে পারে ক্যানসারসহ ভয়ানক রোগ। এমন পরিস্থিতিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা জানায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

জানা যায়, ইটভাটায় খেজুর গাছ ব্যবহার করায় কমেছে গাছের সংখ্যা। দেখা দিয়েছে রসের সংকট। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে ভেজাল গুড়। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কায় এসব গুড় তৈরি বন্ধে জোর দাবি জানিয়েছেন ক্রেতারা। প্রতি কেজি ভেজাল গুড় বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। অথচ এক কেজি খাঁটি গুড়ের দাম ৮০০-৯০০ টাকা।

সৈয়দারবালী এলাকার ক্রেতা সিরাজ মিয়া বলেন, ‘আগে খেজুর গুড় থেকে আলাদা একটা গন্ধ ও স্বাদ পাওয়া যেত। ভেজালের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গন্ধ আর স্বাদ কোনটাই নেই। প্রশাসন স্বোচ্চার থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব করার সাহস পাবে না।’

মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি খান মোহাম্মদ শহীদ বলেন, ‘ভেজাল গুড় যারা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করা উচিত। মানুষকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিচ্ছে এ অসাধু চক্র। আর ক্রেতাদেরও সচেতন হওয়া দরকার।’

কামাল সরদার নামে এক গুড় প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ী বলেন, ‘খাঁটি গুড় তৈরি করলে কেউ সঠিক দাম দেয় না। হালকা চিনি মিশিয়ে তৈরি করলে বাজারে বেশি বেশি বিক্রি হয়, ক্রেতারাও অল্পদাম দিয়ে গুড় কিনে নেয়।’

শওকত সরদার নামে আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে খাঁটি গুড় তৈরি করতাম খেজুরের রস দিয়ে। এখন রস কমে গেছে, তাই শতভাগ খাঁটি গুড় পাওয়া সম্ভব না। অর্ধেক চিনি আর অর্ধেক রস দিয়ে গুড় তৈরি হচ্ছে।’ শামীম সরদার বলেন, ‘আমরা গুড়ে ভেজাল মিশাতে চাই না; কিন্তু ক্রেতারা ৮০০-৯০০ টাকা দিয়ে খাঁটি গুড় কিনে না। খাঁটি গুড় তৈরি করলে বাজারে দাম পাওয়া যায় না।’

মাদারীপুর জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মো. জুয়েল মিয়া জানান, ‘হাট-বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে হাইড্রোজ মিশ্রণে তৈরি গুড়। এ গুড় খেলেই ক্যানসার হতে পারে। তাই ক্রেতাদের সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে, তা না হলে অন্যরা এ সুযোগ পাবে।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাদারীপুরের সহকারী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘যেখানেই খবর পাওয়া যাচ্ছে গুড়ে ভেজাল দিচ্ছে, সেখানেই অভিযান চলছে। এরই মধ্যে শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ও সদরের কালিকাপুরের সরদারকান্দিতে আলাদা অভিযান চালিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে। ভোক্তার স্বার্থে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *