প্রশাসনের গড়িমসি
সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক
ছাত্রত্ব না থাকলেও জাবির সিট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ছাত্রলীগ। ছবি : সংগৃহীত
২০২৩ সালের মার্চে ৫২ ব্যাচের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরীক্ষার ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও হল বরাদ্দের অজুহাতে ক্লাস শুরু করতে গড়িমসি করে প্রশাসন। পরবর্তী সময়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু করলেও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে অনলাইন ক্লাস বর্জন করেন। ফলে সশরীরে ক্লাস চালু করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এরপর প্রতিবছরের মতো নবীন শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হয় গণরুম ও মিনি গণরুমে। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সিটের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে না থাকায় গণরুম প্রথা বিলুপ্ত করা যাচ্ছে না।
কাগজে-কলমে দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খেতাব রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। নামে আবাসিক হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে বেশ আগেই। সিটের জন্য শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। বাধ্য হয়ে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে কিংবা ঢাকা থেকে যাতায়াত করে ক্লাস করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি আবাসিক হলের আসন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ দায়িত্ব হল প্রশাসনের হলেও তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেন না; বরং ‘ছায়া প্রশাসনের’ ভূমিকায় থাকেন ছাত্রলীগের নেতারা। ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ নির্দেশ না মানলে সিট পাওয়া যাবে না—এমন ধারণা সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলে থাকার জন্য এবং কক্ষে সিট পেতে ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ কাছে তাদের ধরনা দিতে হয়। আর হলের আসন সংকটকে পুঁজি করে ছাত্রদের ওপর নানা অত্যাচার চালান ছাত্রলীগ নেতারা।
জানা যায়, শাখা ছাত্রলীগের অন্তত ২৭০ পদধারী নেতার ছাত্রত্ব শেষ হলেও হলে আসন দখল করে রেখেছেন তারা। তাদের অনেকেই চারজনের আসনের একটি কক্ষে দুজন; দুজনের কক্ষে একজন করে থাকছেন। কোনো কোনো হলে চারজনের কক্ষে একজন করে থাকেন। অবৈধভাবে অবস্থান করা এসব শিক্ষার্থীর চাপ পড়ছে বৈধ শিক্ষার্থীদের ওপর। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জায়গা হয়েছে গণরুমে। এক কক্ষের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকছেন ১৫ থেকে ২০ শিক্ষার্থী। এতে পড়াশোনাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত ঘটছে বলে অভিযোগ তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ৬ বছরে স্নাতক ও ২ বছরে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করতে পারবেন। স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পর্ব পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে হলের সিট ছেড়ে দিতে হবে। তবে কোনো শিক্ষার্থী আট বছরে পড়াশোনা শেষ করতে না পারলে উপাচার্যে বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তখন তিনি আর নিয়মিত ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হবেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেও অবস্থান করতে পারবেন না।
শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিতে ৪২তম ব্যাচের দুজন রয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি একজন। যিনি বিশেষ ছাত্র। মাস্টার্সে ফেল করে দলে আছেন। ৪৩তম ব্যাচের ৩২ জন। এর মধ্যে সাধারণ সম্পাদক রয়েছেন। তিনিও মাস্টার্সে ফেল করা বিশেষ ছাত্র।
কমিটিতে ৪৪তম ব্যাচের ৬৫ জন, ৪৫তম ব্যাচের ৭৯ ও ৪৬তম ব্যাচের ৯২ জন অছাত্র রয়েছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি হলে স্বামীকে আটকে রেখে বহিরাগত এক নারীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ও ছাত্রলীগের কর্মী হাসানও রয়েছেন। যাদের সবারই ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। কেউ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হলেই অবস্থান করছেন। হল প্রশাসন সবকিছু জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের ৩২০ ও ৩২২—এ দুটি কক্ষ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের দখলে। দুই কক্ষে আটজনের আসন। কিন্তু অন্য কারও থাকার সুযোগ নেই। কক্ষ দুটি ছাত্রলীগের এই নেতা একাই দখল করে রেখেছেন। ৩২২ নম্বর কক্ষে থাকেন নিজে এবং ৩২০ নম্বর কক্ষ হচ্ছে নিজের আড্ডা রুম। অথচ তার ছাত্রত্বই নেই।
আক্তারুজ্জামান সোহেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগে ভর্তি হন ১০ বছর আগে ৪২তম ব্যাচে (২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ)। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। কিন্তু আক্তারুজ্জামান সোহেল এখনো ক্যাম্পাসে রয়ে গেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩০৬ নম্বর কক্ষে। একই সঙ্গে দখল করে রেখেছেন ৩০৯ নম্বর কক্ষ। দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আটটি সিট একাই রেখেছেন নিজের দখলে। দর্শন বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম ব্যাচ স্নাতক শেষ করেছে ২০১৮ সালে। তার সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হয়েছেন এ ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থী। শুধু দর্শন বিভাগ থেকেই শিক্ষক তার দুই সহপাঠী। তা ছাড়া তিনি পোষ্য কৌটায় ভর্তি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী কোনো পোষ্য কোটার শিক্ষার্থী হলে থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু ৯ বছর ধরে হলে আছেন লিটন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি যুব থাকেন মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে। যুবকে হলে অবৈধভাবে অবস্থানে সহযোগিতা এবং মদত দিচ্ছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল।
রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যমতে, জাবিতে ২০১৩-১৪ থেকে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ৫৭৯ শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়। এর মধ্যে ৩১৩ পোষ্য শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। তাদের কারও হলে থাকার নিয়ম না থাকলেও অধিকাংশ পোষ্যরা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অবৈধভাবে হলে থাকছেন। তাদের মধ্যে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের রহমান ও আরাফাত ইসলাম বিজয়, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদ খান শিমুল, দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন রনি, উপ-দপ্তর সম্পাদক হাসিবুর রহমান, ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক শান্ত মাহবুব, সহ-সম্পাদক মেহেদী হাসান, উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক জিসান আহমেদ রনি, সদস্য মো. তামিম হোসেন প্রমুখ রয়েছেন। তারা সবাই শাখা ছাত্রলীগের সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
এরই মধ্যে গত রোববার সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয় আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অছাত্রদের ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে। কিন্তু অছাত্র নেতাদের ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নিগার সুলতানা বলেন, অছাত্র ও পোষ্য কারোরই আবাসিক হলে থাকার নিয়ম নেই। এরই মধ্যে হলে থাকা অবৈধ শিক্ষার্থীদের তালিকা আমরা প্রস্তুত করেছি। একাধিকবার হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হলেও যারা এখনো অবৈধভাবে হলে থাকছে, তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ছাত্রলীগের অন্যায়, অপকর্মে জড়িত থাকার সুযোগ নেই। যাদের ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিয়ম মান্য করে দ্রুত হল ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে পরে যোগাযোগ করতে বলেন।