পাথর খনি ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ

অন্যান্য খোলা কলাম জাতীয়

কাজী বনফুল


পাথর খনি ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ

পৃথিবীতে কোনো জাতির উন্নতির নিজস্বতার দিকে যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা যেটি দেখতে পাব সেটি হচ্ছে, সে জাতির তার নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি সচেতনতা ও যথাযথ ব্যবহার। কোনো জাতির জন্য যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ প্রকৃতি কর্তৃক অমূল্য উপহারস্বরূপ। যার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সে জাতি পরিণত হতে পারে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে। ঠিক তেমনি আমাদের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে পাথর খনি। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদটি বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় অবস্থিত। বাংলাদেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ গ্রানাইট পাথরের খনি, যা প্রাকৃতিক দিক দিয়ে আশীর্বাদস্বরূপ। পাথর খনিটি মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) হিসেবে ১৯৯৮ সালের ৪ আগস্ট নিবন্ধিত হয়। ২০০১ সালের জুলাইয়ের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্তির সময় নির্ধারিত থাকলেও নামনাম ২০০৭ সালের ২৫ মে খনিটি এমজিএমসিএলের কাছে হস্তান্তর করে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড এবং জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) মধ্যে ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ছয় বছরমেয়াদি বৈদেশিক এবং স্থানীয় মুদ্রায় ১৭১ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা প্রায়) মূল্যমানের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের মধ্যকার চুক্তিটি এখনো চলমান এবং তারা এ খনির পাথর উত্তোলন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পরিমাণের দিক থেকে যত পণ্য আমদানি হয়, তার মধ্যে পাথর অন্যতম। অবকাঠামোর মান বাড়াতে ইটের খোয়ার পরিবর্তে পাথরের ব্যবহার বাড়তে থাকায় দেশে গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিকভাবে এ পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে পাথর, যার ফলে চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের জন্য ইটভাটাগুলো অনেকাংশেই দায়ী। বাংলাদেশের সর্বত্র বিষাক্ত পোকার মতো গজিয়ে উঠছে ইটভাটা নামক পরিবেশ ধ্বংসকারী যন্ত্র।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পাথর আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। প্রতি টন ৩ হাজার ৬০০ টাকা গড় দরে এই পাথরের স্থানীয় বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। গুণগত মানের দিক থেকে মধ্যপাড়া খনির পাথর বিদেশ থেকে আমদানি করা পাথরের তুলনায় উন্নতমানের। দামের দিক থেকেও মধ্যপাড়া গ্রানাইট পাথর (টনপ্রতি ৩৫ ডলার) ভারত থেকে আমদানি করা পাথরের (টনপ্রতি ৪০ ডলার) তুলনায় সাশ্রয়ী। মধ্যপাড়া পাথরের টুকরোর সাইজ চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা সম্ভব।

এই গ্রানাইট পাথর খুবই উন্নতমানের, যা প্রায় ২৫ হাজার পিএসআই চাপ ধারণক্ষমতার সক্ষমতা রয়েছে এ পাথরের। এর উৎপাদন দ্বিগুণ করা গেলে অনেকটা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে, যা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের ডলার সাশ্রয় করবে এবং আমদানিও হ্রাস পাবে।

এখন বর্তমানে এই পাথর খনি থেকে বছরে প্রায় ১৬ লাখ টন পাথর উত্তোলন করা হয়, যা বাংলাদেশের বছরের সামগ্রিক পাথরের চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। বাংলাদেশে বছরে পাথরের চাহিদা হচ্ছে এক থেকে দেড় কোটি টন। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই ১৬ লাখ টন বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। এজন্য আমাদের অন্য দেশ থেকে পাথর আমদানি করতে হয়। সরকার এরই মধ্যে সেই বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পাথর উত্তোলন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। আশা করি খুব দ্রুত আমরা নিজেদের পাথর দিয়ে দেশীয় চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করতে পারব।

কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনার কারণে যেন এমন সম্ভাবনাময় একটি প্রাকৃতিক সম্পদ তার গ্রহণযোগ্যতা না হারায়, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে অবশ্যই অনেক বেশি সচেতন, যার প্রমাণ আমরা এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। আরও দুটি কূপ থেকে পাথর উত্তোলনের সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা নিজস্ব পাথর দিয়ে আমাদের সার্বিক প্রয়োজনকে অনেকাংশে পূরণ করতে সক্ষম হব। আমরা যে পরিমাণ ডলার খরচ করে পাথর আমদানি করি সেটি কমে আসবে এবং আমাদের রিজার্ভ ডলার সঞ্চিত থাকবে, যা আমরা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারব। যেটি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ সরকারের এই খনির বিষয়ে সামগ্রিক সচেতনতা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যা পরবর্তী ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *