সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক
ছবি: বিবিসি বাংলা
বিগ বেনের ঘড়িতে তখন ঠিক দুপুর ১২টা। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের করোনেশন থিয়েটারে সিংহাসনে আসীন তৃতীয় চার্লসের মাথায় রতœখচিত মুকুট পরিয়ে দিলেন আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবেরি। অবসান হল ৭০ বছরের অপেক্ষার। দীর্ঘ সাত দশক পর ব্রিটেনের সিংহাসনে বসলেন কোনও রাজা। ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী রইল গোটা দেশ তথা বিশ্ব।
শনিবার রাজপরিবারের হাজার বছরের রীতিনীতি মেনে সম্পন্ন হল রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক। ৭৪ বছর বয়সে তাঁর হাতে উঠল ব্রিটেনের রাজদণ্ড। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জাঁজমকের ঘাটতি ছিল না। শতাধিক দেশের প্রশাসনিক প্রধান, রাষ্ট্রনেতা, রাজা-রানি, ধর্মগুরু, শিল্পী—কে ছিলেন না অতিথি তালিকায়। আমন্ত্রিতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। যদিও সকাল থেকেই লন্ডনের আকাশের মুখ ছিল ভার। সঙ্গে বৃষ্টির ভ্রূকুটি। কিন্তু কোনও কিছু ব্রিটেনবাসীকে দমাতে পারেনি। ইতিহাসের সাক্ষী হতে সকাল থেকে তারা ছিল রাস্তায়।
এদিনের সকাল ১০টা নাগাদ প্রথা মেনে বাকিংহাম প্যালেস থেকে ডায়মন্ড জুবিলি স্টেট কোচে শোভাযাত্রা শুরু করেন রাজা চার্লস ও কুইন কনসর্ট ক্যামিলা। গন্তব্য ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে। ১৮৩১ সাল থেকে প্রতিটি রাজ্যাভিষেকে এই যানটিই ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্রিটেনের পতাকা হাতে শোভাযাত্রার সামনের সারিতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও তাঁর স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি। তাঁদের ঘিরে ছিল পদাতিক বাহিনী ও ঘোড়সওয়াররা।
চার্লস ও ক্যামিলা ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে পৌঁছতেই সূচনা হয় রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানের। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা। বেলা ১টা নাগাদ ঘণ্টা বাজিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন রাজা-রানি। সেখান থেকে ঘোড়ায় টানা ঐতিহাসিক গোল্ড স্টেট কোচে বাকিংহাম প্যালেসে ফিরে যান তাঁরা। দু’টো নাগাদ প্রাসাদের ব্যালকনিতে দেখা মেলে চার্লস-ক্যামিলার। সেখান থেকেই হাত নাড়িয়ে সাধারণের সঙ্গে তাঁরা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাঁদের সম্মানে এদিন বিশেষ এয়ার শো-র পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, খারাপ আবহাওয়ার জন্য তা কাটছাঁট করা হয়।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরেই ঘোষণা করা হয়েছিস, চার্লস হচ্ছেন পরবর্তী রাজা। এদিন তার ‘আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি’ মিলল। ক্যান্টাবেরির আর্চবিশপ তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান। প্রথার অংশ হিসেবে প্রতীকী বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন রাজা ও কুইন কনসর্ট। বাইবেল পাঠ করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। রাজার হাতে আংটি, বাজুবন্ধ এবং সভেরিনস ওরব তুলে দেন তিন ভারতীয় বংশোদ্ভূত লর্ড।
শুধু ব্রিটেন নয়, এদিন থেকে আরও ১৪টি দেশের রাজা হিসেবে মান্যতা পেলেন চার্লস। তবে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান শুরুর আগেই ট্রাফালগার স্কোয়ারে বিক্ষোভে শামিল হন রাজতন্ত্র বিরোধীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিস। মধ্য লন্ডনে প্রবল ভিড়ের মধ্যে পর্যটকদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয়রা।
সেন্ট এডওয়ার্ডের রাজমুকুট পরানো হয় রাজা তৃতীয় চার্লসকে। তাঁর পরনে ছিল ঠাকুরদার ক্রিমসন ভেলভেটের গাউন। ক্যামিলার মাথায় ওঠে রানি মেরির মুকুট। ১১২ বছর আগে, ১৯১১ সালে রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে সেটি ডিজাইন করা হয়েছিল। তাতে অবশ্য কোহিনুরের দেখা মেলেনি। সোনার পাতে মোড়া রুপোলি ফ্রেম, ২ হাজার ২০০ হীরে দিয়ে মুকুটের নয়া ডিজাইন তৈরি করেছেন শিল্পীরা। জেরুজালেমের গির্জা থেকে আনা পবিত্র তেল দিয়ে রানিকে প্রকাশ্যেই বরণ করা হয়। কিন্তু, চার্লসের জন্য একটি পর্দার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাতে ৫৬টি পাতা সংবলিত একটি গাছের নকশা করা ছিল। প্রতিটি পাতাই নাকি এক-একটি কমনওয়েলথ দেশের প্রতীক। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী, রাজার মাথা, বুক ও হাতে পবিত্র তেল স্পর্শ করিয়ে বরণ করা হয়।
এদিন অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগেই পৌঁছে যান প্রিন্স উইলিয়াম, কেট মিডলটন, প্রিন্স লুইস সহ রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। প্রিন্স জর্জ আলাদাভাবে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছন। প্রিন্সেস অ্যানি ও প্রিন্স অ্যান্ড্রুকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন প্রিন্স হ্যারি। তৃতীয় সারিতে বসেছিলেন তিনি। যদিও অনুষ্ঠানে যোগ দেননি হ্যারির স্ত্রী মেগান।