নিজেস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
এর আগে রাশিয়া ও ইউক্রেন চুক্তি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় গত সপ্তাহে আটা ও ময়দার দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়ে যায় চট্টগ্রামের পাইকারি মোকামে। ভারত গম রপ্তানি বন্ধ রাখায় আমদানিতে বাংলাদেশের বড় উৎস ইউক্রেন ও রাশিয়া। যুদ্ধরত দুই দেশ শস্য পরিবহনের চুক্তি সম্প্রতি নবায়ন করায় ১৯ মার্চ থেকে পরবর্তী দুই মাস ইউক্রেন থেকে আনা যাবে গম। আগের চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গত কয়েক মাসে ১৫ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এ দুই দেশে গমের দামও তুলনামূলক কম। তবে কৃষ্ণসাগরে জাহাজ পর্যবেক্ষণের কারণে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে ইউক্রেন থেকে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে ২০ থেকে ২২ দিন লাগে। কিন্তু এখন জাহাজ তল্লাশি করতেই কৃষ্ণসাগরে অতিরিক্ত সময় লাগছে ৩০ থেকে ৪০ দিন। এতে বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ব্যয়। এর প্রভাব পড়বে পণ্যের দামে।
দেশের অন্যতম শীর্ষ গম আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘ভারত রপ্তানি বন্ধ রাখায় রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জন্য। ইউক্রেন থেকে আসা গম তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়। তবে এ খরচ এখন অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে। জাহাজ তল্লাশির কারণে বাড়তি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে কৃষ্ণসাগরের প্রবেশের মুখে। ৫০ হাজার টন গম নিয়ে আসা তাঁদের একটি জাহাজকে ৪২ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে তল্লাশির জন্য।’ জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেনের এই চুক্তি দেশে আটা ও ময়দার দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বড় ভূমিকা রাখবে। পাইপলাইনে থাকা গম আনতে এখন আর কোনো সমস্যা হবে না বাংলাদেশের।’ খাতুনগঞ্জের তৈয়বিয়্যা ট্রেডার্সের মালিক সোলায়মান বাদশা জানান, আটা ও ময়দার দাম গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে কিছুটা কমেছে। চুক্তি নবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা থাকায় গত সপ্তাহে বাড়তি দামে বিক্রি হয় এ দুই পণ্য।
সময়ক্ষেপণে বাড়বে ব্যয়: গমের উৎস দেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা কমলেও কৃষ্ণসাগরে জাহাজ তল্লাশি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন ব্যবসায়ীরা। বিএসএম গ্রুপের ৫০ হাজার টন গম নিয়ে ইউক্রেন থেকে আসা এমভি আইডিসি ডায়ামন্ড জাহাজকে তল্লাশির জন্য ৪২ দিন অপেক্ষা করায় প্রতিদিন ১৭ থেকে ২০ হাজার ডলার অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে। এই জাহাজটি আগামী ৪ কিংবা ৫ এপ্রিল নোঙর করবে চট্টগ্রাম বন্দরে। একইভাবে ৩০ দিনের অতিরিক্ত সময় অপেক্ষা করে বন্দরে নোঙর করেছে টিকে গ্রুপের জাহাজ এমভি এগ্রি। প্রায় ৫০ হাজার টন গম নিয়ে এ জাহাজটি নোঙর করেছে। একই পরিমাণ গম নিয়ে নোঙর করেছে বসুন্ধরা গ্রুপের জাহাজ এমভি এসএসআই ভিজিল্যান্ড। এই জাহাজটিকেও কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের আগে ৩০ দিনেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে। জাহাজে বিপজ্জনক কিছু আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে তল্লাশি করে রাশিয়া, ইউক্রেন ও জাতিসংঘের যৌথ টিম।
জটিল ছিল সমীকরণ: ইউক্রেনের বন্দরগুলো কৃষ্ণসাগরে অবরুদ্ধ করে রেখেছে রাশিয়া। চুক্তি নবায়ন না হলে ইউক্রেনের বন্দর থেকে কোনো শস্যবাহী জাহাজ বিশ্বের অন্য কোনো দেশে যেতে দিত না রাশিয়া। শস্য পরিবহনে দু’দেশের আগে করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১৮ মার্চ। দুই মাসের জন্য চুক্তি নবায়নের আগে রাশিয়া নতুন শর্ত যুক্ত করায় খাদ্যশস্য আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। রাশিয়া বলেছিল, তাদের শস্য ও সার রপ্তানিতে বাধা দূর করা না হলে ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করবে না তারা। কিন্তু এ অবস্থান থেকে তারা সরে আসায় গম আমদানি নিয়ে বাধা দূর হয়েছে। এখন পাইপলাইনে থাকা গম ঠিকঠাকভাবে দেশে এলে দাম কমতে পারে আটা ও ময়দার। গমের বড় উৎস রাশিয়া ও ইউক্রেন : দেশে প্রতিবছর গম উৎপাদন হয় প্রায় ১১ লাখ টন। বছরে গড়ে গম আমদানি হয় প্রায় ৭০ লাখ টন। আমদানি হওয়া এই গমের ৭০ শতাংশই আটা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। গত ছয় মাসে দেশে প্রায় ২৩ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ অর্থাৎ ৬ লাখ টন গম আমদানি হয় ইউক্রেন থেকে। রাশিয়া থেকে আমদানি হয় প্রায় ৯ লাখ টন গম। দুই দেশের চুক্তি কার্যকরের পর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের ৪৭টি দেশ ইউক্রেন থেকে প্রায় আড়াই কোটি টন শস্য আমদানি করেছে। এই হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত অষ্টম।
ইতিবাচক ইঙ্গিত: চুক্তি আপাতত দু’মাস নবায়ন হলেও এটিকে ইতিবাচক ইঙ্গিত বলে মনে করছে জাতিসংঘ। দু’মাস পর এটি আবার নবায়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দু’দেশের যুদ্ধ শুরুর পর কৃষ্ণসাগর দিয়ে রপ্তানি চালু করতে এ চুক্তি হয় জুলাইয়ে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত বছরের ২২ জুলাই ইউক্রেনের তিনটি বন্দর দিয়ে শস্য রপ্তানিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। এই চুক্তির পর গত ১ আগস্ট ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হয়। গত ১৭ নভেম্বর এই চুক্তি চার মাসের জন্য এক দফা নবায়ন হয়েছিল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রতি মাসে খাদ্য মূল্যসূচক প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ২০২২ সালে খাদ্য মূল্যসূচকের গড় মান ছিল ১৪৩ দশমিক ৭ পয়েন্ট। ২০২১ সালের তুলনায় এটি ১৮ পয়েন্ট বেশি ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য মূল্যসূচক বেড়েছে সারাবিশ্বে।