কেমন হবে পেজেশকিয়ানের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি

আন্তর্জাতিক

সুবর্ণবাঙলা ডিজিটাল ডেস্ক

কট্টর রক্ষণশীলদের বাদ দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংস্কারবাদী মাসুদ পেজেশকিয়ানকে বেছে নিয়েছে ইরানের জনগণ। দুই বছর আগে ইরানজুড়ে সংস্কারপন্থী আন্দোলনের ছায়া দেখা গেছে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। পেজেশকিয়ানের জয়লাভের পর ইরানের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি কেমন হবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে কৌতূহল।

গত মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় কট্টরপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু হলে ইরানে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। নির্বাচনে মনোনীত ছয় প্রার্থীর মধ্যে মাসুদ পেজেশকিয়ান ছিলেন একমাত্র সংস্কারপন্থী। গত ২৮ জুন প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়ায় গত শুক্রবার দ্বিতীয় ধাপে ভোটের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন প্রথম ধাপে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া পেজেশকিয়ান ও কট্টরপন্থী সাইদ জালিলি। দ্বিতীয় ধাপে ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পান পেজেশকিয়ান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জালিলি পান ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট।

ইরান ফ্রন্ট পেজের খবরে বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমের নীতি বাস্তবায়নে পেজেশকিয়ানকে দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি শক্তিশালী সংস্কারবাদী ভিত্তিকে আরও শক্ত করতে চাইবেন।

হৃদ্‌রোগবিশেষজ্ঞ ৬৯ বছর বয়সী পেজেশকিয়ান ২০০৮ সাল থেকে ইরানের পার্লামেন্টের সদস্য। দেশটির কট্টরপন্থী সরকার ও বিতর্কিত নীতি পুলিশের কর্মকাণ্ডের সমালোচক তিনি। এ নীতি পুলিশের হেফাজতে ২০২১ সালে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুতে দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। এবারের নির্বাচনে ইরানের প্রধান সংস্কারপন্থী জোটও পেজেশকিয়ানের পাশে ছিল। ফলে তার জয়লাভ অনেকটা সহজ হয়।

নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ইরানের নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন পেজেশকিয়ান। ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা বুঝে পাবেন তিনি। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইরানের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘সামনে কঠিন পথ। আপনাদের সাহচর্য, সহানুভূতি ও আস্থা ছাড়া সামনের কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া কঠিন হবে। আমি আপনাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।’

অভ্যন্তরীণ নীতি

কট্টরপন্থীদের ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণার মাঝে নারীর অধিকার, অধিক সামাজিক স্বাধীনতা, পশ্চিমের সঙ্গে বৈরিতায় সতর্কতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ঘোষণা দেন পেজেশকিয়ান। স্থবির হয়ে পড়া দেশের অর্থনীতি চাঙা করা, অব্যবস্থাপনার অবসান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

নির্বাচনের আগে এক ভিডিও বার্তায় পেজেশকিয়ান ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘চেষ্টা করেও আমি যদি আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হই, তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিদায় জানাব। তা আর চালিয়ে যাব না। আমাদের জীবনে ও প্রিয় জনগণের সেবা করার ক্ষেত্রে সময় নষ্টের সুযোগ নেই।’

নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ভোটারদের উদ্দেশ্যে পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, ‘নতুন যুগ শুরু হলো।’

কেমন হবে পররাষ্ট্রনীতি

সংস্কারপন্থী পেজেশকিয়ান এমন এক সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, যখন অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিকভাবে নানামুখী সমস্যায় রয়েছে দেশটি। গাজায় যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ ঘিরে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ইরানপন্থী নানা সশস্ত্র সংগঠন। এছাড়াও পারমাণবিক প্রকল্প নিয়েও দিন দিন দেশটির ওপর পশ্চিমাদের চাপ বাড়ছে।

এনবিসি কানেকটিকাটের প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন, পেজেশকিয়ানকে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনা সামাল দেওয়া। পারমাণবিক প্রকল্পে লাগাম টানতে পশ্চিমাদের সঙ্গে ২০১৫ সালে তেহরানের যে চুক্তি হয়েছিল, সেটির নবায়ন করা। এসব ক্ষেত্রে মার্কিন তথা পশ্চিমাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের বিরোধের ঝুঁকি তাকে এড়াতে হবে।

এসব সমস্যা সমাধানে পেজেশকিয়ান কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, ইরানে রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বড় সিদ্ধান্তগুলো আয়াতুল্লাহ খামেনির পরামর্শে নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে পারমাণবিক চুক্তি বা মধ্যপ্রাচ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়া সংক্রান্ত নীতিতে পেজেশকিয়ান বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফারস মিডিয়া ফ্যাকাল্টির অধ্যাপক ও ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মোস্তফা খোশচেশম বলেন, ইরানের পররাষ্ট্রবিষয়ক সিদ্ধান্তের পেছনে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার হাত থাকে। বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে দেশটির সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে সরকারের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সামরিক বাহিনী, সর্বোচ্চ নেতা খামেনি ও পার্লামেন্ট সদস্যরা রয়েছেন। তাই বলতে গেলে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি একই থাকবে। বলা চলে, এই নীতি আগের মতোই এগোবে, তবে ভিন্ন গতিতে।

পাশে থাকার আশাবাদ বিশ্বনেতাদের

পেজেশকিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর রাশিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরবসহ অনেক দেশের নেতারা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা সবাই ইরানের সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত নতুন এই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পাশে থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা।

নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর পরই পেজেশকিয়ানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, ‘আপনার দায়িত্ব পালনকালে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের গঠনমূলক দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার হবে।’ দুই দেশের প্রতি পশ্চিমাদের রোষানলের ইঙ্গিত করে পুতিন বলেন, ‘আমরা দুই দেশই আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলো গঠনমূলক উপায়ে সমাধানে সমন্বিত অবদান রাখতে পারব।’

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং পেজেশকিয়ানকে অভিনন্দন জানিয়ে তার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে জানিয়ে অভিনন্দনবার্তায় সি বলেন, ‘চীন-ইরানের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলতে নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক আমি।’

সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান পেজেশকিয়ানকে পাঠানো এক অভিনন্দনবার্তায় ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করতে দুই দেশের মধ্যে সমন্বয়, আলোচনা অব্যাহত আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানও আলাদাভাবে পেজেশকিয়ানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক সাত বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় শুরু হয়।

ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আশা প্রকাশ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘আমাদের উষ্ণ ও দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থেকে দুই দেশের জনগণ ও অঞ্চল যাতে লাভবান হতে পারে, সে জন্য আমি আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চাই।’

ইরানের পূর্ব দিকের প্রতিবেশী পাকিস্তানও দেশটির নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ লিখেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশ হিসেবে পাকিস্তান–ইরানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের অবশ্যই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের জনগণের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।’

আবার এক বিবৃতিতে আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে ইরানের সঙ্গে কাজ করার আশা প্রকাশ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি।

এছাড়াও পেজেশকিয়ানকে অভিবাদন জানিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুল লতিফ জামাল রশিদ, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোসহ অনেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *