‘আমি মোস্তফা জব্বার, আপনাকে একদিন সময় দিলাম’

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি রাজনীতি

সুবর্ণবাঙলা ডেস্ক


সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং লেখক। ছবি : সংগৃহীত

একটা গল্প বলবো যেটা বলিনি কোনোদিন, আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রীর থেকে সরাসরি হুমকি পাওয়া এক নতুন স্টার্টাপের গল্প।

সালটা ছিল ২০২১, এদিক ওদিক চাকরি আর বিদেশি অ্যাসাইনমেন্ট থেকে আয় করা টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম নিজের স্টার্টাপ ব্যবসা। ইনভেস্টমেন্ট, প্রোডাক্ট মার্কেট ফিট, এমভিপি, এসবের হালকা ধারণা হয়েছিল তবে তখনো গভীরভাবে জানা বাকি।

স্টার্টাপটা ছিল মুদি দোকানদারদের সাথে ফ্রন্ট আর ব্যাক এফিলিয়েশন। টিম বানালাম কিছু বন্ধু আর ফেসবুকে পরিচয় হওয়া কিছু টেলেন্ডেড মানুষের সাথে। অনেক খেটে একটা ১ মিনিটের ওভিসি (বিজ্ঞাপন ভিডিও) বানালাম। হাজার হাজার ব্যনার, পোস্টার আর স্টিকারে বিভিন্ন এলাকার চারদিক ভরে ফেল্লাম। একদিন খুব আয়োজন করে টিমের সবাই মিলে পাবলিসিটি করলাম, ২০ জনের কাছাকাছি টিম হওয়ায় বেশ সারা পেল, হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে গেল আমাদের ব্র্যান্ডের নাম।

১৫ আগস্ট, ২০২১ এর কথা। সম্ভবত শুক্রবার, বেলা ৩টা বা একটু বেশি। একটা অজানা নাম্বার থেকে কল এলো, রিসিভ করলাম। কলদাতা : আপনি কি ‘বিজয় ডিএসএস’ পেইজ এর ওনার বলছেন? আমি : জ্বি বলছি, কীভাবে সহায়তা করতে পারি বলুন। কলদাতা : আমার নাম মোস্তফা জব্বার! আমি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আছি। ‘বিজয় ডিজিটাল’ আমার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান, আমার কাছে সকল কপিরাইট আছে। আপনি বিজয় নামে প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন না। আমি : স্যার, আমি খুবই গর্বিত আপনি কল করেছেন। আপনার হাত থেকে আমি ঝ২ঝ-এর পুরস্কার পেয়েছি (আইসিটি ডিভিশনের একটি বিজনেস কম্পিটিশন)। জব্বার : এসব বাদ দেন, এই মুহূর্তে আপনার পেইজ, ওয়েবসাইট বন্ধ করেন। আমি : স্যার, বাংলাদেশে প্রায় ৮০টার মতো প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিজয় নামে অপারেট করে, জঔঝঈ এর ওয়েবসাইটে গেলেই পাওয়া যায়। আমরাও নেইম ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি, রেজিস্ট্রেশন করছি। লিগালি আমরা কোনো দোষ করিনি। জব্বার : আমাকে এতো লজিক দেখাতে যাবেন না। আপনি আমার প্রতিষ্ঠানের নাম চুরি করেছেন। আপনাকে আমি একদিন সময় দিলাম, এর মধ্যে এই নাম সরিয়ে ফেলবেন। আর তা না হলে কীভাবে আপনাকে সোজা করবো সেটাও আমার জানা আছে, একদম দেখিয়ে দেব। আমি : স্যার, আমার কয়েক লক্ষ টাকার মার্কেটিং কন্টেন্ট অলরেডি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে গেছে, আমার সব বিনিয়োগ শেষ হয়ে যাবে। জব্বার : সেটা আমার দেখার বিষয় না, আজকের পরে যেন বিজয় নাম না দেখি (বলে ফোন কেটে দিল)। আমার রুমে দাড়িয়েই ফোনে কথা বলছিলাম, ফোন রেখে মনে হলো আমার পায়ের নিচের থেকে মাটি সরে গেছে। বেঁচে আছি না মরে গেছি কিছু অনুভব করতে পারছিলাম না। একটু পরে টিমকে জানালাম, কিছু বন্ধু আর সিনিয়রকে ফোন করলাম, জিজ্ঞেস করলাম এখন কী করব। অনেকেই অনেক বুদ্ধি দিল। একজন বলল, মোস্তফা জব্বারকে আমার উচিত আবারও ফোন দিয়ে কনভিন্স করা। তবে আমি আর ফোন দেইনি, টেক্সট করেছিলাম। লিখেছিলাম, ‘স্যার আমার অনেক বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে যাবে, আমি কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ফেলব, তবে খুব কৃতজ্ঞ থাকব যদি আইসিটি ডিভিশনের কোন ফ্যসিলিটি পাওয়ার জন্য আমাকে একটু রেফার করতেন।’ উনি রিপ্লাই দিয়েছিলেন, ‘আপনাকে যে জেলে দেইনি এটাই আপনার ভাগ্য, এই নাম্বারে আর যোগাযোগ করবেন না।’ এভাবেই একরম গায়ের জোড়ে, কোন লিগাল গ্রাউন্ড ছাড়া, হুমকি আর ভয় দেখি আমার থেকে কেড়ে নেয়া হলো আমার বহুদিনের গড়া পরিচয়। জীবনে এরকম ভয়, অসহায়ত্ব আর আত্মসমর্পণ কখনো কল্পনা করিনি।

১৬ আগস্ট, ২০২১ এ আমরা কোম্পানি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজ ডাউন করে ফেলি। খিলগাঁও, মিরপুর, ওয়ারী ও মতিঝিল থেকে ‘বিজয় ডিএসএস’-এর বেশিরভাগ ব্যনার, পোষ্টার সরিয়ে ফেলি। দুই মাস পরে, নতুন নামে লাইসেন্স করি, ‘দুর্জয় ডিএসএস’, পরবর্তিতে জঔঝঈ রেজিস্ট্রেশন করি, ‘দুর্জয় ডিএসএস টেকনোলজিস লিমিটেড।’ আমার কাছের বেশকিছু বন্ধু ও সিনিয়র এই ঘটনা সম্পর্কে জানেন। একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস আমার ছিল না। তার ‘দেখিয়ে দেব’ হুমকির পরে নিরাপদও মনে করিনি। শুধু চুপ করে নিজের কয়েক লাখ টাকার বিনিয়োগ জলে ফেলে পরাজয় মেনে নিয়েছিলাম। ইতিহাস জানে, জালিমের পতন অবধারিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *