ইকবাল মাহমুদ
আমি পিকে হালদার দেখিনি, বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চুকেও দেখিনি। তবে আমি নিজের চোখে দেখেছি সিলেটে দূর্নীতির দুই বরপুত্র ডা. মুর্শেদ আহমদ চৌধুরী আর নইমুল হক চৌধুরীকে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দূর্নীতির এমন উলঙ্গ মহড়া কোনকালে কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর্ভাগ্য যে তার জন্মলগ্নে এমন আপাদমস্তক দূর্নীতিবাজ দুজন ব্যক্তি ভিসি ও রেজিস্ট্রার এর দায়িত্ব পেয়েছিলো।
একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক, অবকাঠামোগত এবং একাডেমিক কাঠামো নির্মানের চ্যালেঞ্জ থাকে। মুর্শেদ- নইমের সেই চ্যালেঞ্জ নেয়ার যোগ্যতা এবং প্রচেষ্টা কোনটাই ছিলো না। পদ পেয়েই তারা এটিকে একটি টাকা বানানোর মেশিন ভাবতে শুরু করেছিলেন। এডহক নিয়োগের নামে শত শত চাকরি প্রত্যাশী তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে দুই হাতে টাকা নেন। প্রতিটি নিয়োগে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নেন মুর্শেদ এবং নইমুল। দেড় শতাধিক নারী-পুরুষকে এডহক নিয়োগ দিয়ে ৩০ কোটি টাকা হজম করেন। কিন্তু টাকার লোভ তাদের থামেনি। আরো দুই শতাধিক তরুণ তরুণীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তিতে নিয়োগ দেয়ার জন্য ঝুলিয়ে রাখেন। কিন্তু বিধি বাম এরই মধ্যে তাদের দূর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসে গণমাধ্যমে। দুজনকেই বিদায় নিতে হয়েছে।
২০১৮ সালে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টার সময় ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। তিনি তখন এর উপাচার্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ফেডারেশন তখন তাকে গ্রহন করেনি।মুর্শেদ তখন সিলেটী ইজম তুলেন। সিলেটের মানুষও এই ইজমে প্রভাবিত হয়ে তাকে সমর্থন করে ব্যাপক লেখালেখি করেন। সবশেষে নিজের স্ত্রীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন মুর্শেদ। তার স্ত্রী আমাতুজ জোহরা রওশন জেবিন রুবা বঙ্গবন্ধুর সহচর, সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর কন্যা। ফরিদ গাজীকে ভালো করে চিনতেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর আব্দুল হামিদ। একসময় একসাথে জেল খেটেছেন এই দুই নেতা। সেই সুবাদে স্বামী মুর্শেদকে নিয়ে বঙ্গভবনে ছুটে যান জেবা। ‘চাচার’ হাতে পায়ে ধরে স্বামীর নিয়োগ বাগিয়ে নিয়ে আসেন।
এদিকে, স্বামীকে উপাচার্য বানিয়ে নিজেই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান জেবা। নবীণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বানিজ্যের দোকান খুলে বসেন। চাকরি প্রত্যাশীদেরকে উপাচার্যের বিবির কাছে ইন্টারভিউ দিতে হত। সুবিদবাজারের বাসায় বসে খোলামেলা টাকার কন্টাক্ট করতেন। এমনকি যেদিন কথা বলতে যাবেন সেদিনই কিছু অগ্রীম পেমেন্ট দিয়ে আসতে হত তাকে। বাকী টাকা কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ ছিলো। প্রতিটা কিস্তি নিজের ডায়রীতে লিখে রাখতেন জেবা। কড়ায় গন্ডায় টাকা পরিশোধ হলেই তার চাকরির ফাইল এগুতো। প্রথম দফায় নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা ,কর্মচারীকে এ নিয়োগ বানিজ্যের সহযোগী বানান মিসেস উপাচার্য। তারাই খদ্দের নিয়ে আসতো , ম্যাডামের সাথে কথা বলিয়ে দিতো। সুবিদবাজার ব্লুবার্ড স্কুলের উল্টোদিকের বাসায় গত রমজান মাসের এক রাতে পরিচয় গোপন রেখে এক চাকরি প্রত্যাশীর সাথে গিয়েছিলাম আমিও। আধা ঘন্টার বেশি সময় উপাচার্য এবং মিসেস উপাচার্য পাশাপাশি সোফায় বসে ওই চাকরিপ্রার্থীর সাথে খোল্লাম খোল্লাম দরদাম করেন। পুরোটা সময় আমি নিশ্চুপ ছিলাম। উপাচার্যও তেমন কোন কথা বলেননি। পাঞ্জাবির ওপর ঘি রঙ এর শাল পরা উপাচার্য প্রথমেই তার বেগম সাহেবার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘উনার সিভি কার কাছে? ‘আমার কাছে আছে, ফাইলে কাজ চলছে’- গুরুগম্ভীর গলায় জেবার উত্তর। তারপর শুরু হলো লেনদেনের আলাপ। পুরোটা সময় সর্দারনির মত একাই দর কসাকসি করে যাচ্ছিলেন মিসেস উপাচার্য। “অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি না করছে- সেই তুলনায় আমরাতো কিছুই না” বার বার শোধাচ্ছিলেন বেগম উপাচার্য।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ) পদে ছিলেন নঈমুল হক চৌধুরী।
২০১৮ সালে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এর ফাইনান্স ডিরেক্টর (অতিরিক্ত দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ) পদে যোগদান করেন। সেসময় এক সন্ধ্যায় জনৈক বড়ভাইয়ের সাথে শিবগঞ্জ লামাপাড়ায় নঈমুল হক চৌধুরীর বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। অনেক গল্পগুজবের এক পর্যায়ে সেই বড়ভাই তাকে প্রশ্ন করলেন- একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জ নিলেন কেন? নঈমুল হকের জবাব “শুনো একটা উদাহরন দেই; এখানে লাইব্রেরির জন্য ৫০ লাখ টাকার বই কিনতে হবে। কোলকাতার একটা কোম্পানির সাথে আলাপ করেছি। তারা ৫০% কমিশনে বই দেবে। কিন্তু বিল দেবে পুরো ৫০ লাখ টাকার। আমার লাভ কত হচ্ছে? পাক্কা ২৫ লাখ। এটাতো খুব মামুলি খাত বললাম। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় , এমন কেনাকাটা- প্রকল্প হামেশাই আসবে। জায়গা কেনা হবে, অনেকগুলো বিল্ডিং হবে। শাবিপ্রবিতে গাধার খাটুনি খেটে আমার লাভ কি?”
কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের নামাজ পড়ে আসা নূরানী চেহারার নঈমূলের এই উত্তরে ওই বড় ভাই আর আমি পরস্পরের দিকে শুধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। আমাদের আর কথা বাড়ানোর রুচি হয়নি।
নঈমুল হক চৌধুরী খুব সৌখিন মানুষ। তার পোশাক আশাক, চলাফেরা রাজসিক। একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার বেতনের সমান তার পকেট খরচ। ফলে তার বেতনের উপর নির্ভর করে থাকা কঠিন। ভিসি ডা. মুর্শেদ আহমদ চৌধুরী অর্থলোভী হওয়ায় তাকে দিয়ে যাচ্ছেতাই করিয়ে নেয়া সহজ হয় নঈমুল হক চৌধুরীর। ফলে প্রথম পদক্ষেপেই শুরু করেন নিয়োগ বানিজ্য। ফিফটি ফিফটি কমিশনে ভিসি-রেজিস্টার রফা হয়ে যায় দ্রুত। দুহাতে পয়সা কামানো শুরু হলো। শাবিতে থাকা অবস্থায় গাছের ব্যবসা করে বিপুল আর্থিক লস করেছিলেন নাঈমুল। এসময় বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ৫ কোটি টাকার দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মাশাআল্লাহ সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে ৩ বছর চাকরি করে সমুদয় ঋন শোধ করে সম্প্রতি আম্বরখানা বড় বাজারে জায়গা কিনেছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাড়ি করার। নিজ এলাকা জকিগঞ্জে বিপুল জায়গা জমি কিনেছেন, খামার করেছেন।
নইমুল হক চৌধুরী অত্যন্ত চালাক ও ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক ছিলেন। অন্যদিকে ভিসি ডা মুর্শেদ এর প্রশাসনিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিলো কম। ফলে টাকার ভাগ পেয়ে তিনি অন্ধের মত সিগনেচার করে গেছেন। যার ফল হিসেবে ঢাল নাই, তলোয়ার নাই প্রতিষ্ঠানে এক এক করে ২৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেন সহজেই।
(কৈফিয়ত- সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এই সিরিজ বন্ধ করতে অনেক কর্ণার থেকে আমাকে চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এমন কিছু বিষয় এখনও লেখার বাকী যা না লিখলে ধূম্রজাল থেকে যাবে। বিশেষ করে এতকিছুর পরও সাবেক ভিসি ও রেজিস্ট্রারের রেখে যাওয়া সেটআপ কিভাবে এখনও অনিয়ম-দুর্নীতির রাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে তাতো জানানো দরকার। তাই আরো কয়েকটি পর্ব লিখতে হবে আমাকে। তবে বিশেষ কারণে এই আইডিতে আর নয়।চলবে…