বিশ্বাস কতটা ভয়ানক হতে পারে!
কেনিয়ার খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারক পল ম্যাকেঞ্জি তাঁর অনুসারীদের যিশুর দেখা পেতে মৃত্যু পর্যন্ত অনাহারে থাকতে বলায় শত শত ধর্মান্ধ না খেয়ে থাকে। এরমধ্যে মারা যাওয়া ৭৩ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আরো বহু ধর্মান্ধ মারা গিয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পল ম্যাকেঞ্জি কিন্তু নিজে না খেয়ে মরেননি। বিশ্বাস এমনটাই ভয়ানক হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে বহু স্থানেই এমন ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জঙ্গিদের মধ্যেও এমন একটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, ‘ব্লগার ও মুক্তমনাদের হত্যা করতে পারলেই বেহেস্তে যাওয়া যাবে’। তাতে আকৃষ্ট হয়ে বহু তরুণই খুনের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। তাদের হাতে বহু মানুষই খুন হন। জাপানের মতো উন্নত দেশে গুরু শোকো আশাহারার মতো ধর্মগুরুর নির্দেশে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল তার ধর্মীয় অনুসারীরা। আশাহারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে বলেছিল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। দলত্যাগের জন্য তার অনুসারীরা বহু মানুষকে হত্যাও করে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসরণে তিনি একটি ককটেল ধর্ম বানিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন পৃথিবীতে কেবল তার অনুসারীরাই বেঁচে থাকবে। তারা মারা গেলেও আবার পুনর্জন্ম লাভ করবে। মহামুক্তির সনদ পেয়ে তার অনুসারী ধর্মান্ধরা সার্জিক্যাল মাস্ক পরে জাপানের পাতাল রেলে বিষাক্ত সেরিন গ্যাস ছড়িয়ে দেয়। তাতে ১৩ জন মারা যায় আর অসুস্থ হয়ে পরে হাজার হাজার মানুষ। এগুলোকে অবাস্তব ও অসম্ভব মনে হলেও বাস্তবেই ঘটেছে। আমরা চরমোনাই পীরের অনুসারীদের স্ট্যাজে উঠে লাফালাফি করতে দেখি অপ্রকৃতস্থ হয়ে। কেন হয়?
ভগবান রজনিশের ভক্ত
জেরুজালেম সিনড্রোম বলে একটা মানসিক রোগ রয়েছে। কিছু মানুষ জেরুজালেমে আসলেই নিজেকে ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের নবী ভাবতে শুরু করে। একে বর্তমানে ‘জেরুজালেম স্কোয়াবল পয়জন’ বলা হয়। জেরুজালেমের পুলিশ হোটেলগুলোকে বলে রেখেছে কারো মধ্যে এমন আচরণ দেখলে পুলিশকে জানাতে। পুলিশ তাদের মনো চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ওরা জেরুজালেম ছেড়ে চলে গেলেই ভালো হয়ে যায়। এমন অসুখের কথা আরো শোনা যায়। যেমন হোয়াইট হাউজ দেখতে গিয়ে অনেকে নিজেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভেবে বসে। আবার ইতালির ফ্লোরেন্সে চিত্রকলা দেখতে গিয়ে নিজেকে চিত্রকলার অংশ ভেবে বসে। ধর্ম মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারেই এমন সিনড্রোম তৈরি করে দিতে পারে। হলি আর্টিজানে হামলাকারীরা বারবারই বলেছিল, ‘আমাদের জন্য হুরপরীরা অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সরাসরি বেহেস্তে চলে যাবো।’ এমনকি শাহজাহান বাচ্চু ভাইর খুনিরাও ক্রস ফায়ারের মুখে নাকি বলেছিল, ‘গুলি করেন। মরলেইতো বেহেস্তে চলে যাবো। হুরপরীরা অপেক্ষা করছে।’ যোগী রাম-রহিম সিং এর ৫ কোটি অনুসারী ছিল ভারতে। তার কোন অপকর্মই উন্মাদ শিষ্যরা দেখতে পায়নি। ভগবান রজনীশ ছিলেন আধ্যাত্মিক যৌন গুরু। তিনি বলতেন, অবাধ যৌনতার মাধ্যমেই পৃথিবীতে শান্তি আনা সম্ভব। তার আশ্রমে ছিল অবাধ যৌনাচারের সুযোগ। এজন্য তিনি শিষ্যদের ড্রাগ নিতে বলতেন। তার বাণি ছিল ‘সম্ভোগ সে সমাধি’। অর্থাৎ যৌন মিলন করতে করতে মরে যাওয়া। অর্থাৎ বৌদ্ধ মতের সেই নির্বাণ লাভের মতোই আরকি। শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ তে যৌন মিলন করতে করতে দুটি মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে।
গুরু শোকো আশাহারার
পৃথিবীতে ৪৩০০টি ধর্ম এবং আরো অসংখ্য উপধর্মের ধর্মান্ধরাই এমন। তারা তার পীর/গুরুর কথায় অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে। তারা ধর্মগুরুদের প্রভাব থেকে বের হতে পারে না। এ এমন এক আকর্ষণ, এমন এক লোভ যে তা অতিক্রম করার সামর্থ্য ওই সমর্থকদের থাকে না। তারা জীবন উৎসর্গ করে দেয়, অন্যের জীবন নিয়ে নেয় পীর/গুরু/বাবার কথায়। বাংলাদেশে মামুনুল হকের দুজন অন্ধ ভক্ত নিজের বউকে উৎসর্গ করে দিয়েছিল মামুনুলের লালসা মেটানোর জন্য। জাপান, আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও এদের ভয়াবহতা দেখা যায়। আর আমাদের মতো দেশে, যেখানে অধিকাংশ মানুষই গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে না, সেখানে হালি আর্টিজানের খুনিদের উত্থান ঘটতেই থাকবে।
এর থেকে পরিত্রাণের একটিই পথ আর তা হল এসব নিয়ে অনবরত বিতর্ক তৈরি করা। কিছু মানুষ কান-চোখ বন্ধ করে রাখে, যাতে সত্যটা দেখতে না হয়, শুনতে না হয়। এদেরও শোনাতে হবে, দেখাতে হবে। বিতর্ক এতো জোরালো ভাবে আনতে হবে যাতে ওই বন্ধ রাখা কান/চোখ ওয়ালার কাছেও তা পৌঁছায়। নইলে পৃথিবী থেকে এমন মরণঘাতি মৌলবাদ দূর করা যাবে না। নির্বোধ মানুষ এমনটা করতেই থাকবে। যুক্তি বুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সমাজ তৈরি করতে হবে।
(অনার্য মামুনের ওয়াল থেকে)।