স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কৃষি ব্যবস্থার পূনর্গঠন

খোলা কলাম

এস,এম লুৎফর রহমান

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ গঠনের মূল দর্শনই ছিল কৃষি উন্নয়ন। যখন ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তখন দেশের ৮৫ ভাগ মানুষ এবং মোট জাতীয় আয়ের ৬০ শতাংশ ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, ১৯৭০ সালের সাইক্লোন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কৃষিখাতকে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্র¯’ করে। ১ কোটির বেশি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে, ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়, প্রায় ২ কোটি লোক নিজের বাড়ীঘর ছেড়ে অন্যত্র অবসস্থান নেয় এবং রাস্তাঘাট ও বাড়ীঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৭০ সালের সাইক্লোন মোট জাতীয় উৎপাদনের ৩.৮০ শতাংশ বিনষ্ট করে এবং ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ২৬ শতাংশ হ্রাস পায়। বাংলাদেশের কৃষি খাত, শিল্প খাত, ব্যবসা খাত এবং ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষি উপকরণ নেই। ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ লক্ষ টন।

এমন বাস্তবতায় কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক পুর্নগঠন কাজে কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেন। তিনি সামগ্রীক কৃষি খাতকে উন্নয়নের জন্য তৈরী করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, হর্টিকালচার উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড এবং
উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নের কর্মকান্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। বিপর্যস্ত কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি কৃষকের মাঝে নামমাত্র মূল্যে ৫০ হাজার গাভী ও ১ লক্ষ হালের বলদ সরবরাহ করেন। কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে ১০ কোটি টাকা ঋণ এবং সমবায় সমিতির জন্য ৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং স্বল্প মূল্যে পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে প্রায় অর্ধেক মূল্যে সার সরবরাহ করেন। ৫০,০০০ হাজার টন সার নামমাত্র মূল্যে বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ইউরিয়া সারের মূল্য ২০ টাকায় ১ মণ, টিএসপি ১৫ টাকায় ১ মণ এবং পোকা মারার ঔষধ বিতরণ করা হয় প্রায় বিনা মূল্যে। ২১২৫ মন বোরো ধানের বীজ, ৩০০০ মন গম বীজ, ১৭০০ মন আলু বীজ সরবরাহ করা হয়। ৫৩টি চালকল ও আটাকল স্থাপন করা হয় এবং ২৯১ টি পুনঃসংস্কার করা হয়। ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯৮টি সরকারী
খাদ্য গুদাম নির্মাণ করেন।

এছাড়াও, তিনি কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ১৯৭২ সালে ১৩ জানুয়ারী প্রথম বৈঠকে কৃষকের বকেয়া সব খাজনা মওকুফ করে দেন। ১০ লক্ষ কৃষকের ঋণের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করেন। পরিবার প্রতি জমির সর্বোচ্চ সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করেন এবং অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করে দেন। ১ লক্ষ একর খাস জমি কৃষকদের মাঝে বন্টন করেন। গ্রাম অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা বৃদ্ধি করেন যাতে কৃষকরা ঋণ সুবিধা পেতে পারেন।

চরের জমিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতি আদেশ নং ১৩৫ এর মাধ্যমে নদী কিংবা সমুদ্রের গর্ভে জেগে উঠা চরের মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে তা দারিদ্র কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেন।

কৃষি আধুনিকায়নের লক্ষ্যে এবং কৃষি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত মেধাবী কর্মী বাহিনী । তাই মেধাবীরা যাতে কৃষি ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হয় তার জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাজেটে মোট উন্নয়ন বাজেট ছিল ৫০০ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে কৃষি অবকাঠামো পুনর্গঠনে জন্য নামমাত্র মূল্যে ৪০ হাজার ইঞ্জিন চালিত পাম্প, ২৯০০টি গভীর নলকূপ এবং ৩০০০টি অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে দেশে ১১ হাজার ইঞ্জিন চালিত পাম্প ছিল যা ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে ৩৬ হাজারে উন্নীত হয়। ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি করেন এবং ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা আদায় করেন।

(লেখক পরিচিতি : এস,এম লুৎফর রহমান
এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড
সাংগঠনিক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *