বিশ্বে যে সাতটি ভাষায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে

অন্যান্য শিক্ষা-গবেষণা ও ক্যাম্পাস সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য

বিবিসি বাংলা

বিশ্বে বর্তমানে সাত হাজার ১৬৮টি ভাষা আছে। এর ৪২ শতাংশ ভাষাই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থায় আছে। অর্থাৎ তিন হাজার ৪৫টি ভাষা এখন বিলুপ্তির পথে। সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক্স (এসআইএল) ইন্টারন্যাশনালের ভাষা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘এথনোলগ’ এ তথ্য জানিয়েছে।

যেসব ভাষা পৃথিবীতে এখনো টিকে আছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা কোনগুলো। কিংবা বিশ্বে কোন কোন ভাষায় মানুষ সবচেয়ে বেশি কথা বলে? এমন সাতটি ভাষার বিষয়ে জানব, বিশ্বে যেগুলোর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এ তালিকায় বাংলা ভাষার স্থানও রয়েছে।

বিশ্বে ১৫০ কোটি মানুষই ইংলিশে কথা বলে

প্রথমেই ইংলিশের নাম আসবে। ইংলিশ বা ইংরেজি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটি ভাষা। বিশ্বে খুব অল্প কয়েকটি দেশের মাতৃভাষা ইংরেজি। অথচ এমন দেশ বিরল যেখানে মাতৃভাষার পর ইংলিশকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না।

এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, ৮০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষই ইংলিশে কথা বলে। যদিও পৃথিবীর মাত্র ৩৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা ইংলিশ এবং মাতৃভাষাভাষীর সংখ্যার বিচারে এর অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।

এই ভাষার আঁতুড়ঘর হলো যুক্তরাজ্য, অর্থাৎ ইউনাইটেড কিংডম। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও ইংলিশের এ বিস্তৃতির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে কয়েকশ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে চলা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ।

ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটলেও উপনিবেশবাদের প্রভাব রয়ে গেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র একক আধিপত্য বিস্তার করে। যুক্তরাষ্ট্রের মাতৃভাষাও ইংলিশ হওয়ায় মার্কিন সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই সেটি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠে।

এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট ১৪৬টি দেশে ইংলিশ ভাষাভাষী মানুষ পাওয়া যায়। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশ।

বিশ্বের ৯৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষা মান্দারিন চাইনিজ

চীনের অধিকাংশ মানুষ কথা বলে মান্দারিন চাইনিজ ভাষায়। যদি শুধুমাত্র মাতৃভাষার কথা বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিশ্বে মান্দারিন চাইনিজ ভাষাভাষীর সংখ্যাই সর্বোচ্চ।

এথনোলগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৯৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষা মান্দারিন চাইনিজ। এছাড়া বিশ্বের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ মান্দারিন চাইনিজে কথা বলে। সেক্ষেত্রে, ইংলিশের পরেই এর অবস্থান। মান্দারিন ভাষাভাষীর সংখ্যা এতো বেশি হওয়ার কারণ, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশ চীন। ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটিসটিকস অব চায়না-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যা ১৪০ কোটির একটু বেশি।

এথনোলগ জানিয়েছে, চীনের ৮১ শতাংশ মানুষ মান্দারিন চাইনিজে কথা বলে। এছাড়া, কানাডা, মিয়ানমার, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ মোট ৩৭টি দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মান্দারিন ভাষাভাষী রয়েছে।

বলা হয়ে থাকে যে চীনে জন্ম নেওয়া মান্দারিন চাইনিজ বিশ্বের অন্যতম কঠিন ভাষা। ৫০০০ বছরের বিবর্তনে তৈরি এই মান্দারিন চাইনিজ সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের একটি ভাষা।

বিশ্বের ৬০ কোটি ৯০ লাখ মানুষ হিন্দি ভাষাভাষী

জনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে হিন্দি ভাষাভাষীরা। এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি ৯০ লাখ মানুষ হিন্দিতে কথা বলে। এদের মধ্যে ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা হিন্দি। হিন্দি ভাষাভাষী মানুষের বসবাস ভারতেই বেশি। তবে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে হিন্দি ছাড়া আরও বিভিন্ন ভাষা আছে। সেই হিসেবে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা হিন্দি।

ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশটির মোট ২২টি দাপ্তরিক ভাষার মাঝে হিন্দি অন্যতম। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভারতে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এ দিনটি হিন্দি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। হিন্দির সঙ্গে আরও কিছু ভাষার উচ্চারণগত মিল রয়েছে। যেমন- বাংলা, উর্দু, নেপালি, ভোজপুরি, রাজস্থানি ইত্যাদি।

১৯৫০ সালের পর থেকে বলিউড সিনেমার উত্থানও হিন্দি ভাষাকে বিশ্বব্যাপী নতুন করে পরিচয় করে দিয়েছে।

বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা স্প্যানিশ

পৃথিবীতে প্রায় ৫৬ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। সে হিসেবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা স্প্যানিশ। মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বের প্রায় ৪৯ কোটি মানুষ স্প্যানিশে কথা বলে। এদিক দিয়ে ম্যান্ডারিনের পরেই স্প্যানিশের অবস্থান। অর্থাৎ মাতৃভাষা হিসেবে এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। ইংলিশসহ মোট ছয়টি ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বলা হয়। সেই ছয়টি ভাষার একটি স্প্যানিশ।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মেক্সিকোতে স্প্যানিশ ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরপরই আছে কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেন।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের রোমান্স শাখার ভাষা স্প্যানিশ বর্তমানে মোট ১৮টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা। ব্রিটেনের মতো স্পেনও এক সময় বিশ্বের অনেক দেশকে নিজেদের কলোনি করে রাখে এবং পরবর্তীতে সেসব জায়গায় এ ভাষার প্রভাব রয়ে যায়। যার বেশিরভাগই ল্যাটিন আমেরিকায়।

ফরাসি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি

ফরাসি বা ফ্রেঞ্চও জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ইংরেজির পাশাপাশি ফ্রেঞ্চকে তাদের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।

এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান পৃথিবীতে ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি।

ব্রিটানিকা জানিয়েছে, বিশ্বের ২৫টিরও বেশি দেশে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এর ব্যবহার আছে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো- ফ্রান্স এবং কানাডা। এর বাইরে রয়েছে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ। এছাড়া সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে প্রচুর ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষী পাওয়া যায়।

স্প্যানিশের মতো ফ্রেঞ্চের বিস্তৃতির পেছনেও অন্যতম কারণ উপনিবেশবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের কলোনি বিস্তার করেছিলো ফ্রান্স, যার অধিকাংশই আফ্রিকা মহাদেশে। এই কারণেও ফরাসি ভাষা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্বে আরবি ভাষাভাষীর সংখ্যা ২৭ কোটির বেশি

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মানুষের মাতৃভাষা হচ্ছে আরবি। আবার অনেক দেশের মাতৃভাষা না হলেও সেখানে ব্যাপক হারে আরবির প্রচলন রয়েছে। সেমেটিক ভাষা পরিবারের বৃহত্তম ভাষা এই আরবি জাতিসংঘের অন্যতম একটি দাপ্তরিক ভাষা।

এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে আরবি ভাষাভাষীর সংখ্যা ২৭ কোটির বেশি। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩০টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলজেরিয়া, মিশর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, মরক্কো, ওমান, সৌদি আরব, সুদান, সিরিয়া ইত্যাদি।

ধর্মীয় কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় অনেকে কম-বেশি আরবি লিখতে, পড়তে, বলতে জানেন। আরবি ভাষার সাথে অন্যান্য ভাষার একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। আরবি লিপি লেখা হয় ডান থেকে বামে।

সপ্তমে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ

বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ভাষাগুলোর মাঝে বাংলা সপ্তম। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে বাংলাদেশে এবং এরপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে।

এথনোলগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ২৭ কোটির বেশি।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগের আগে থেকেই ভাষা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নির্দেশ দেয় এবং পাকিস্তান সরকারের এমন ঘোষণার বিরোধিতা করে বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ। তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে এই নিয়ে আন্দোলন চলতে থাকে। সেটি সংঘাতে রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। কিন্তু সেই মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি যায়, তখন পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। সেই গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে শহীদ হন। তবে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণে সেদিন সারাদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়।

ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর বাংলাকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সবশেষে, বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন এবং ভাষার অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *