সুবর্ণবাঙলা অনলাইন ডেস্ক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়ে বিপুল অস্ত্র লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। লুণ্ঠিত এসব অস্ত্রের বেশিরভাগ উদ্ধার হলেও এখনো বেহাত প্রায় দুই হাজার অস্ত্র, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ, লুটের এসব অস্ত্র চলে গেছে পেশাদার অপরাধীদের হাতে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে অস্ত্রভিত্তিক ‘গ্যাং’। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লুণ্ঠিত অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে বেশি। কিছু অস্ত্র চলে গেছে সুন্দরবন অঞ্চলের দস্যুদের হাতেও।
বেহাত অস্ত্র পুলিশে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। কারণ এই অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটনের মাত্রা বেড়েছে। বিষয়টি দেখা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হিসেবে। নিয়মিত পুলিশি অভিযানের পাশাপাশি যৌথ অভিযান চালিয়েও লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে আশানুরূপ সফলতা মিলছে না।
জানা গেছে, সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সভা থেকে তালিকা প্রস্তুত করে অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক
(ক্রাইম) আকরাম হোসেন বলেন, আমরা বিভিন্ন সূত্র ও গোয়েন্দা অনুসন্ধানে কিছু তথ্য পাচ্ছি। সেসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, লুণ্ঠিত কিছু অস্ত্র সুন্দরবন কেন্দ্রিক বা দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সন্ত্রাসীদের হাতে গেছে। তিনি জানান, আন্তঃজেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে এক সভায় বলা হয়, বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া ৪৫০টি পিস্তল, লাখ লাখ গুলি উদ্ধার করা যায়নি। কিছুদিন আগে নোয়াখালী থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংসহ অপরাধীদের যেসব গ্যাং আছে, তাদের কাছে এসব অস্ত্র থাকতে পারে। তাদের টার্গেট করে অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। অভিযানের ব্যাপ্তি ঘটলে সাধারণ মানুষ কেউ যদি লুট করা অস্ত্র রেখে থাকে, সেগুলো রাখার সাহস পাবে না। তা ছাড়া গ্যাংগুলো এসব অস্ত্র অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করবে এবং পরে বিক্রির চেষ্টা করবে। পুলিশকে কৌশলে সেগুলো উদ্ধার করতে হবে।
পুলিশের একজন সদস্য জানান, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে অস্ত্র উদ্ধারে ব্যবহারের জন্য ব্যাকপ্যাক সংকট আছে। দ্রুততার সঙ্গে কিছু ব্যাকপ্যাক সংগ্রহ করা গেলে অস্ত্র উদ্ধার সহজ হবে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, লুট হওয়া কিছু অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাত ঘুরে সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দস্যুদের হাতে চলে গেছে। সেগুলো উদ্ধার করা না গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
তিনি জানান, সুন্দরবন এলাকায় দস্যুদের হাতে প্রায়ই জেলে, মৌয়ালসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অপহরণের শিকার হচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে নগদ টাকাসহ বিভিন্ন দামি সরঞ্জাম লুট করছে। আবার জিম্মি করে টাকা আদায় করা হচ্ছে। বন বিভাগের নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে গেলে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি করছে। ফলে জিম্মি হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বনদস্যুদের গ্রেপ্তার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানা কর্মসূচিও পালন করেছেন।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের একজন সাংবাদিক জানান, ৫ আগস্ট রাতে শ্যামনগর থানায় লুটপাট হয়। এসব অস্ত্র উপকূলীয় দস্যুদের হাতে চলে গেছে।
শ্যামনগরের বাধঘাটা গ্রামের শেখ আফজালুর রহমান জানান, ৫ আগস্টের আগে পারিবারিক তিনটি বন্দুক ও রাইফেল থানায় জমা রাখেন। থানা থেকে লুট হওয়ার পর সেগুলো আর ফেরত পাননি। তিনি জেনেছেন তার অস্ত্রগুলো দস্যুরা নিয়ে গেছে। শ্যামনগর থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্ট সন্ধ্যার আগে থানায় আগুন দিয়ে দুর্বৃত্তরা থানা ভবনে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা অস্ত্র লুট করে দ্রুত পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যায় যখন থানায় অস্ত্র লুট হয়, তখন স্থানীয় চিহ্নিত অপরাধী, ডাকাত এবং আত্মসমর্পণ করা বনদস্যুদের কয়েকজনকে সেখানে দেখা যায়। থানা থেকে তারা অস্ত্র নিয়ে গেছে। সেগুলো দিয়েই দস্যুতা করছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট গণভবন থেকে নিরাপত্তা সংস্থা এসএসএফের ৩২টি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বেহাত হয়। যার মধ্যে এসএমজি টি-৫৬, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি ড্রোন গান, অ্যান্টি ড্রোন সিস্টেম ও বেতার যোগাযোগের ডিভাইসও ছিল। এখন পর্যন্ত সেসব অস্ত্র উদ্ধারের কোনো তথ্য মেলেনি।
পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৬০টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতন-পরবর্তী সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ হাজার ৮১৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বেহাত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ৩ হাজার ৯৩৩টি। উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৮৮৫টি অস্ত্র। উদ্ধার না হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ২৯৬টি চায়না রাইফেল (সিআর), আটটি বিডি রাইফেল, চায়না এসএমজি ৬০টি, এলএমজি ১১টি, চায়না পিস্তল ৫৪টি, ৯ বোরের পিস্তল ৬৫৩টি, এসএমজি একটি, ১২ বোরের শটগান ৬৫৩টি, সিঙ্গেল গ্যাস গান ১১৭টি, ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার পাঁচটি ও সিগন্যাল পিস্তল দুটি। উদ্ধার না হওয়া গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বোরের গুলি ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪০৫টি, টিয়ার গ্যাসের শেল ৮ হাজার ৮১১টি, টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ৭৫১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ২ হাজার ৫৬৪টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ৭৭টি, সেভেন মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৩৭টি, ফ্ল্যাশ ব্যাংক গ্রেনেড ৩৬০টি, হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে ৮৩টি। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে যৌথ বাহিনী।
গত ৫ নভেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানা পুলিশের অভিযানে সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী এলাকা থেকে ৯টি ম্যাগাজিন, পাঁচটি বিদেশি পিস্তলসহ ১৭টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৭৭ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে যৌথ সভায় উপস্থিত একজন কর্মকর্তা বলেন, থানা, ফাঁড়িসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তা উদ্ধারের চিত্র হতাশাজনক। বারবার তাগাদা দিয়েও অস্ত্র উদ্ধারে সফলতা মিলছে না। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস কালবেলাকে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার শুধু র্যাবেরই নয়, সরকারের অগ্রাধিকার। র্যাব ইতোমধ্যে অন্তত ২৬০টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া র্যাবের খোয়া যাওয়া ৯০টি অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে। যৌথ অভিযানেও র্যাব কাজ করছে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান চালানো হচ্ছে।
সুন্দরবনের দস্যু ও সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। আমাদের কাজ চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া মাত্রই র্যাব অভিযান চালাচ্ছে।
লুটের অস্ত্র বিভিন্ন গ্যাং বা দস্যুদের হাতে থাকাটা বড় হুমকি বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষক ও সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা। তিনি বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুন-ডাকাতির মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করতে আমরা দেখেছি। তাই গ্যাংয়ের কাছে থাকুক বা যার কাছেই থাকুক, লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করতেই হবে। কারণ এসব অস্ত্র তারা ভালো উদ্দেশ্যে নিজেদের কাছে রাখেনি। এসব অস্ত্র উদ্ধার না করা গেলে তা আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে।